'চল বদলে যাই'

আশির দশক দেশে স্বর্ণোজ্জ্বল সময় পার করে ব্যান্ডসংগীত। প্রতিটি বাড়িতে, সব শ্রেণির মানুষের মাঝেই ছিল ব্যান্ড গানের জনপ্রিয়তা। আর ওই জনপ্রিয়তার চূড়ায় ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু । তিনি নেই, চলে গেছেন না–ফেরার দেশে—এ এক অদ্ভুত বিষণ্নতা। গলার ভেতরে আটকে আছে দলাপাকানো কষ্ট। একঝলকে নিয়ে যাচ্ছে পুরোনো স্মৃতিতে।

মূলত রক ঘরানার কণ্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক গান, ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত ও লোকগীতি দিয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি। বহু সিনেমার প্লেব্যাক করেছেন। বিভিন্ন ঢংয়ের অসাধারণ সব গান। তাঁর কণ্ঠ দেওয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’।

আইয়ুব বাচ্চু অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা। চল বদলে যাই, রুপালি গিটার, রাত জাগা পাখি হয়ে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, মাধবী, ফেরারি মন, এখন অনেক রাত, ঘুমন্ত শহরে, বার মাস, হাসতে দেখ, এক আকাশের তারা, উড়াল দেব আকাশে—গানগুলো যেন কখনোই পুরোনো হয় না, কখনোই এগুলোর আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। ব্যান্ডসংগীতের প্রতি তারুণ্যের জোয়ারের ধারা ধরে রেখেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।

আইয়ুব বাচ্চু, জয়, স্বপন এবং এস আই টুটুল ছিলেন এলআরবি ব্যান্ডের চার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সময়টা ১৯৯১। এরপর একে একে যোগ দেন মিল্টন, রিয়াদ, সুমন ও কাজী হাবলু। এলআরবি প্রথম কনসার্ট করে ঢাকার একটি আন্তর্জাতিক ক্লাবে। শুরুটা ছিল ইংরেজি গান দিয়ে। বহু কনসার্টে শ্রোতা-ভক্তের চাহিদার কারণে রাত কেটে গেছে এমন নজিরও আছে। দর্শকদের চাওয়াকে কখনোই উপেক্ষা করে করেননি আইয়ুব বাচ্চু। গভীর আবেশে আপ্লুত করেছেন শ্রোতাদের।

মনে পড়ে ‘চল বদলে যাই’ গানটির কথা। কী পরিমাণ সাড়া জাগিয়েছিল, গানটি সেই পরিমাপে এখন নাই বা না যাই। গানের প্রতিটি কথা–সুর যেন গেঁথে যায় মানুষের মনে। সবার মনের কথা যেন এই চল বদলে যাই। ১৯৯৩ সালে এই গানটির জন্ম। বছর দুয়েক আগে প্রথম আলোতে এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু জানান তাঁর নিজেরও পছন্দ এ গানটি।

গানটির গল্প সর্বজনীন। দুটি মানুষ যখন প্রেমে পড়ে বা প্রেম করে, তখন তাদের ভালো লাগা, ভালোবাসা, রাগ-অনুরাগ—সবকিছুর মধ্যে একটা পারস্পরিক দায়বদ্ধতা ও প্রতিশ্রুতি থাকে। কিন্তু সেই দুজন মানুষ যখন এক ছাদের নিচে চলে আসে, তখন বাস্তবতা তাদের গ্রাস করে। তারা ভুলে যায় সেই প্রতিশ্রুতি আর দায়বদ্ধতার কথা। চেনার ভেতরেও যেন তারা অচেনা হয়ে পড়ে। কিন্তু কখনো কখনো একাকিত্বে তারা অনুভব করে পেছনের সেই ভালো লাগা, ভালোবাসার কথা। আবার বদলে আগের মতোই হয়ে যাওয়ার ইচ্ছেগুলো তাড়া করে তাদের—এ ভাবনাগুলোই উঠে এসেছে গানটিতে।

এলআরবির সুখ অ্যালবাম বের হওয়ার পর গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, এলআরবির কনসার্ট মানে ‘চল বদলে যাই’ থাকতেই হবে।

আইয়ুব বাচ্চু ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘গানটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে গাওয়ার সময় দেখেছি, সব দর্শক আমাদের সঙ্গে গানটি গাইছে। শুধু এ দেশেই নয়, একই দৃশ্য ভারতের কলকাতায় দেখেছি। তার মানে গানটি আর আমার বা এলআরবির নেই। সবার গান হয়ে গেছে। কারণ, গানটির কথাগুলো শাশ্বত। সবার অন্তরের কথা।’

প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের একটা ভরসার জায়গা লাগে। নিঃসংকোচে যার সৃষ্টি গ্রহণ করা যায়। আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতকে শ্রোতাদের কাছে সেই ভরসার জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। আইয়ুব বাচ্চুর গান মানেই নতুন কিছু, ভালো কিছু—এই ভরসা ছিল আমার মতো অসংখ্য শ্রোতার মনে।