অনুশীলন নাট্যদলের ৪০ বছরে পদার্পণ

অনুশীলনের নতুন প্রজযোজনা বুদেরামের কূপে পড়া নাটকের মহড়া চলছে
অনুশীলনের নতুন প্রজযোজনা বুদেরামের কূপে পড়া নাটকের মহড়া চলছে

ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটারে এন্তারনেট–এর দ্বিতীয় প্রদর্শনী হবে। দিন ঠিক হয়েছে ৭ অক্টোবর, ২০১৬। তার তিন দিন আগে এই নাটকের প্রধান চরিত্রের অভিনেত্রী ঘোষণা দিলেন তিনি আর কাজ করবেন না। নাটকটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুশীলন নাট্যদলের। সংগঠনের অধিকর্তা নাট্যকার মলয় ভৌমিকের জন্য ছিল এটা একটা বড় ধাক্কা। তিনি হাল ছেড়ে দিলেন না। এই সামান্য সময়ে তিনি আরেকজন নতুন মেয়ে খুঁজে এনে প্রধান চরিত্রের জন্য দাঁড় করিয়ে দিলেন। যথারীতি প্রদর্শনী হলো। বলা বাহুল্য, প্রথম প্রদর্শনী যাঁরা দেখেননি, তাঁরা অভিনেত্রী বদলের বিষয়টি বুঝতেই পারেননি। তবু তাঁকে একটা বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যচর্চা সব সময়ই এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিতে হয়। প্রশিক্ষিত কর্মীরা প্রতিবছর চলে যান। আবার নামতে হয় নতুনের সন্ধানে। কাজ করতে হয় বৈরী পরিবেশে। এভাবেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নাট্য সংগঠন অনুশীলন নাট্যদল এবার ৪০ বছরে পা রাখল। এই দীর্ঘ সময়ে এক দিনও থামেনি সংগঠনটির পথচলা। এখানে মৌলবাদীরা মঞ্চ পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসন অসহযোগিতা করেছে। এসবের ভেতর দিয়েই নিজস্ব ঐতিহ্যের ওপরে দাঁড়িয়ে বিশ্বরূপকে খোঁজার প্রত্যয় নিয়ে অনুশীলন নাট্যদল বাংলাদেশে নাট্য আঙ্গিকের স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছে।

এটি হলো আমাদের হাজার বছরের নিজস্ব নাট্যের অসাম্প্রদায়িক আঙ্গিকগুলো তুলে এনে বর্তমান সময়ের সুর-তাল-লয়-ছন্দ-গতির সঙ্গে মিলিয়ে পৃথক আঙ্গিকে নাট্য উপস্থাপন। আর এই আঙ্গিকের নাট্য উপস্থাপনের জন্য ‘এম্পটি স্পেস’, পোর্টেবল, লিস্ট কস্ট—অতি আধুনিক বিশ্বনাট্যের এই ধারণাগুলোর যথাযথ প্রয়োগ ঘটাচ্ছে দলটি; অর্থাৎ দল স্বল্প ব্যয়ে সহজে বহনযোগ্য উপকরণ ব্যবহার করে নাট্য নির্মাণের মাধ্যমে যেকোনো স্থানে নাটক মঞ্চায়নের জন্য প্রস্তুত থাকে। ভালো মঞ্চ পেলেও দলের নাট্য আছে, না থাকলেও আছে। দর্শক পেলেই হলো।

১৯৭৯ সালের ৮ অক্টোবর ‘নাট্য আন্দোলন সমাজ পরিবর্তন আন্দোলনের একটি অংশ’ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল দলটি। দলটি আজও দেশে-বিদেশে নাট্য প্রদর্শনের মাধ্যমে এই স্লোগান শৈল্পিকভাবে আরও ধারালো করে যাচ্ছে। দেশ, জাতি, সমাজের ক্রান্তিকালে নাটক নিয়ে মাঠে নেমেছে দলটি। সারা দেশে মুক্তনাটক দলের সঙ্গেও কাজ করেছেন অনুশীলনের কর্মীরা। নাট্যদলটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই প্রাণপুরুষ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন মলয় ভৌমিক। নাটকে অবদান রাখার জন্য দীপু স্মৃতি পদক, মুনীর চৌধুরী পদক ও নাট্যসাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লায়েড থিয়েটার বিভাগের মাস্টার্স শ্রেণিতে মলয় ভৌমিকের উত্তরখনা নাটকটি পাঠ্যসূচিভুক্ত হয়েছে।

আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি গত ২০ আগস্ট দুপুরে রবীন্দ্র ভারতীর নাটক বিভাগের অহীন্দ্র মহড়াকক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে বাংলাদেশের নাটকের গতি–প্রকৃতি, মুক্তনাটক বিষয়ে নাট্যকাররূপে তাঁর অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, দর্শন এবং কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। বিশেষভাবে তাঁর উত্তরখনা নাটকটি নাটক বিভাগের পাঠ্য হওয়ায় সেটি সম্পর্কিত নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। এ নিয়ে একুশ শতক ডটকম নামে পশ্চিমবঙ্গের একটি অনলাইন বিস্তারিত লিখেছে।

এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অনুশীলনের ঝুলিতে জমা হয়েছে ৬৩টি প্রযোজনা এবং এই প্রযোজনাগুলোর ছয় শতাধিক প্রদর্শনী। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছেন কয়েক শ নাট্যকর্মী। বিকশিত হয়েছে নিজস্ব নাট্যকার, নির্দেশক, ডিজাইনার। আয়োজন করা হয়েছে কর্মশালা। প্রায় প্রতিবছর নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। অনুশীলনের প্রযোজনা নিয়ে যেমন বিদেশে গেছে, তেমনি থিয়েটারকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাড়িত করেছে শহর থেকে গ্রামে মুক্তনাটকের মাধ্যমে।

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঠাকুরদালান মঞ্চে আমন্ত্রণ পেয়েছিল অনুশীলন নাট্যদল। এই মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেছেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে একমাত্র অনুশীলন নাট্যদল ওই মঞ্চে নাটক করার সুযোগ পেয়েছে। এই দলের অভিনীত রবীন্দ্রনাথের রথের রশি সেখানে প্রশংসিত হয়েছে।

গত ১৫ অক্টোবর সোমবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু ভবনে অনুশীলনের মহড়াকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, নতুন প্রযোজনা বুদেরামের কূপে পড়া নাটকের মহড়া চলছে। মলয় ভৌমিকের নির্দেশনাধীন এই নাটকটির জন্য ইতিমধ্যে আগরতলার লিটল ড্রামা গ্রুপ আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর সেখানে নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। আমন্ত্রণ এসেছে কলকাতার মধ্য গ্রামের ‘জার্নি থিয়েটার’ থেকে। আন্তর্জাতিক নাট্যোত্সবে। আগামী ১৩ জানুয়ারি সেখানে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তানের নাটক মঞ্চস্থ হবে। অনুশীলন নাট্যদল মঞ্চস্থ করবে বুদেরামের কূপে পড়া।

এতসবের পরেও মলয় ভৌমিক এখন যা বলেন, ‘অনেক সমস্যার মধ্যেও এখনো আলো দেখি। দর্শক সংযোগের মাধ্যমে সে আলো পৌঁছে দিতে চাই দর্শকপরম্পরায়, সেটি অবশ্যই শিল্পসম্মতভাবে, নতুন সৃজনে বিশ্বরূপকে ধারণ করে। থিয়েটারের শক্তি অপার। চল্লিশ বছরে আমার সাবেক ও বর্তমান কর্মী, দর্শক–শুভানুধ্যায়ীকে আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’