পঞ্চাশ পেরিয়ে উদীচীর দীপ্ত পথচলা

শহীদ মিনারে উদীচীর সূবর্ণজয়ন্তীর সমাপনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো
শহীদ মিনারে উদীচীর সূবর্ণজয়ন্তীর সমাপনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ছবি: প্রথম আলো

উদীচীর ৫০ বছর পথচলা পূর্ণ হলো। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর শুরু। ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী হেঁটেছে গ্রামগঞ্জে, শহরে-বন্দরে, এমনকি দেশের বাইরে। সংকল্পে অবিচল থেকেছে। গেয়েছে গণমানুষের গান, অংশ নিয়েছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। উদীচী এক সক্রিয় আন্দোলনের নাম। পঞ্চাশে উদীচী বুড়িয়ে যায়নি, ফুরিয়ে যায়নি। এখনো তাদের দীপ্ত পথচলা। নানা সময়ে তাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিল দেশমাতৃকার অনুরাগের কথা, কখনো ছিল প্রতিরোধ-প্রতিবাদের দীপ্ত উচ্চারণ। 


৫০ বছরের পথচলাকে উদ্‌যাপন করতে উদীচী গত বছর ২৯ অক্টোবর থেকে বছরব্যাপী কর্মসূচি শুরু করে। এই কর্মসূচির আওতায় গত এক বছরে জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন, সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও প্রতিযোগিতা, বইপড়া প্রতিযোগিতা, নৃত্য উৎসব, লোক-সংস্কৃতি উৎসবসহ বিচিত্র আয়োজন করেছে। এ কর্মসূচির বিদায়ের সুর বেজেছে, গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ‘আঁধারবৃন্তে আগুন জ্বালো, আমরা যুদ্ধ আমরা আলো’ প্রতিপাদ্যে তিন দিনের সমাপনী আয়োজন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই সমাপনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন উদীচীর সাবেক তিনজন সভাপতি অধ্যাপক পান্না কায়সার, সৈয়দ হাসান ইমাম ও কামাল লোহানী। এ সময় ৫০টি পায়রা উড়িয়ে দেন অতিথিরা। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, উদীচীর উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। জাতীয় সংগীত ও সংগঠন সংগীত গীত এবং জাতীয় ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ আয়োজন। এতে অংশ নেন উদীচীর তিন শতাধিক শাখা সংসদের কর্মীরা।

উদ্বোধনীতে গান-নাচ-আবৃত্তি-অভিনয়ের মাধ্যমে উদীচীর ৫০ বছরের গৌরবময় ইতিহাসের খণ্ডচিত্র তুলে ধরেন শিল্পী-কর্মীরা। ইতিহাসের সূচনাপর্ব লেখা হয়েছিল ’৬৮ সালে পুরান ঢাকার নারিন্দায় সাইদুল ইসলামের বাসায় সত্যেন সেন, গোলাম মোহাম্মদ ইদুসহ কয়েকজন সমাজসচেতন দুরন্ত তরুণের কলমে। সেখানেই উদীচী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সভাপতি ছিলেন সত্যেন সেন, সহসভাপতি গোলাম মোহাম্মদ ইদু, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা ওয়াহিদ খান, সহসাধারণ সম্পাদক ইকরাম আহমেদ। ছিলেন রাজিয়া বেগম, ইকবাল আহমেদ, আখতার হুসেন, মাহফুজ আলী মল্লিক, তাজিম সুলতানা প্রমুখ।

নাম কেন উদীচী? উদীচী শব্দের অর্থ ‘উত্তর দিক’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘উদীচী’, সংগঠনটির গোড়াপত্তন ঘটেছিল ঢাকা নগরীর উত্তর দিকের নারিন্দা দক্ষিণ মৈশুন্দীর একটি বাসায়। এসব থেকেই অনুপ্রেরণা। তবে সত্যেন সেন আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, নামকরণের তাৎপর্য আরও গভীর। উত্তরে থাকে ধ্রুবতারা। সেই ধ্রবতারা লক্ষ্য করেই আঁধার রাতে নাবিকেরা তাদের গন্তব্য ঠিক করে নিত। নামকরণের এই হলো তাৎপর্য।

শহীদ মিনার থেকে শোভাযাত্রা বের করা হয়ে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে
শহীদ মিনার থেকে শোভাযাত্রা বের করা হয়ে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে

শুধু গণসংগীতেই সীমিত ছিল না উদীচীর ভ্রমণ। পাশাপাশি নিয়মিত মঞ্চস্থ করেছে নাটক। কখনো কখনো শত্রুর চোখ রাঙানি, বুলেট, বোমা থামিয়ে দিতে চেয়েছে উদীচীর কর্মকাণ্ড। কিন্তু সত্যেন সেনের সঞ্জীবনী সংগীত ‘মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচিত গান মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ’ উদীচীর কর্মীদের নিরন্তর অনুপ্রাণিত করেছে। কর্মীরা ছুটে গেছে মানুষের কাছে। মানুষের মন জাগাতে, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে।

বর্তমানে সক্রিয় নাচের দলটিও। চারুকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ তৈরি করেছে উদীচীর যশোর হত্যাকাণ্ডের ওপর ‘ক্ষতচিহ্ন’, গোবিন্দগঞ্জের নারকীয় উচ্ছেদের ওপর ‘ভূমিহীন ভূমিপুত্র’, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ওপর তৈরি হয়েছে ‘ম্যাডোনা ৪৩ ’, কমরেড জসীম মণ্ডলের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ফায়ারম্যান’, কমরেড বরুণ রায়ের সংগ্রামভিত্তিক ‘ভাসানপানি’, কমরেড রবি নিয়োগীর জীবনভিত্তিক ‘দ্বীপান্তরের বন্দি’। দেশে ও বিদেশে উদীচীর শাখা এখন ৩৭৬টি। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করে।

গতকাল সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, দীর্ঘ পথচলায় সংগঠনটির বৈশিষ্ট্য ও কৌশলগত হয়তো কিছু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সংগঠনটির মূল সুর—নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কাজ করা, মানবতার পক্ষে কাজ করা, এটি অব্যাহত রয়েছে। কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক সফিউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘উদীচী কোনো বিলাস বিনোদন ও শুধু আনন্দদানের সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়। দেশ ও সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য উদীচীর লড়াই। দেশ ও সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য উদীচী সব সময় শোষণ, নির্যাতন, অন্যায়, অবিচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে।’

উদীচীর সাবেক সভাপতিদের পক্ষে পান্না কায়সার বলেন, উদীচী গণমানুষের পাশে থাকার প্রত্যয় ও বিশ্বাস নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই প্রত্যয় ও বিশ্বাস এখনো সংগঠনটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলন-সংগ্রামে উদীচী রাজপথে ছিল। সাফল্যও এসেছে। কিন্তু উদীচীর যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে উদীচীর যুদ্ধ এখনো চলছে এবং সেই যুদ্ধেও উদীচী জিতবে।

শহীদ মিনার থেকে বের করা হয় শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ, মৎস্য ভবন ঘুরে শোভাযাত্রাটি এসে শেষ হয় শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। সেখানেই ছিল আলোচনাপর্ব।

সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় উদীচীর শিল্পীরা
সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় উদীচীর শিল্পীরা

শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আলোচনাপর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর, ফ্রান্সের প্যারিসের উবারভ্যালিয়ার্সের ডেপুটি মেয়র অ্যান্থনি দাগে প্রমুখ। বিভিন্ন সময়ে উদীচীর নানা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়া সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি, কল্যাণ সেন বরাট, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, বিমল দে, বিপুল চক্রবর্তী ও অনুশ্রী চক্রবর্তী উদীচীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য দেন।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পর্বে গান শোনান পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী কল্যাণ সেন, শুভেন্দু মাইতি ও পূরবী মুখোপাধ্যায়। এরপর ছিল স্থানীয় শিল্পীদের বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। এরপর ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সেখানে ভারত থেকে আমন্ত্রিত তিন শিল্পী কল্যাণ সেন বরাট, শুভেন্দু মাইতি ও পূরবী মুখোপাধ্যায় সংগীত পরিবেশন করেন। উদীচীর বান্দরবান জেলা সংসদের শিল্পীরা পরিবেশন করেন নৃত্য। শ্রীমঙ্গল শাখা ‘প্রাণে প্রাণ মিল করে দাও’, ময়মনসিংহ সংসদ ‘সাদী মোবারক', যশোর সংসদ ‘আরশির সামনে’ এবং গোপালগঞ্জ সংসদের শিল্পীরা পরিবেশন করেন গীতি–আলেখ্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন বেলায়েত হোসেন ও শিবানী মাইতি।

আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার এ দুই দিনই শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে থাকছে আলোচনা, পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।