বাংলাদেশে আবার আসতে চাই, অভিনয়ের জন্য

>

‘ইউ আর আ শিট অ্যাকট্রেস’—মনীষা কৈরালার অভিনয় দেখে এভাবেই বলেছিলেন বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা বিধু বিনোদ চোপড়া। এমন রূঢ় মন্তব্য শুনে ভেঙে পড়তে পারতেন সে সময় সবে অভিনয়ে থিতু হওয়া মনীষা। কিন্তু সেই মন্তব্যই জেদ হয়ে চেপে বসে মনীষার ওপর। এক রাতের মধ্যেই বদলে যায় তাঁর গল্প। সেই গল্পই মনীষা বললেন প্রথম আলোকে। ঢাকা লিট ফেস্টে এসে নেপালি বংশোদ্ভূত বলিউডের এই অভিনেত্রী প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত আলাপে বসেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আদর রহমান

ঢাকা িলট ফেস্টে প্রথম আলোর মুখোমুিখ মনীষা কৈরালা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঢাকা িলট ফেস্টে প্রথম আলোর মুখোমুিখ মনীষা কৈরালা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

০ থেকে ১০০

১৯৪২
: আ লাভ স্টোরি ছবির অডিশনের প্রথম দিন। বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক বলিউডি ছবিতে অভিনয় করে মনীষা নিজেকে ‘প্লাস্টিক অভিনেত্রী’ ভাবতে শুরু করেছিলেন। প্লাস্টিকের হাসি-কান্না-প্রেম-নাচ-গানে ধুন্ধুমার হিন্দি ছবিতে চরিত্রের গভীরে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। তাই যখনই জানলেন বলিউডের খ্যাতনামা পরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়া একটি পিরিয়ড ড্রামা ঘরানার ছবির জন্য অভিনেত্রী খুঁজছেন, ছুটে যান মনীষা।

মনিটরের দিকে তাকিয়ে বিধু। অভিনয় শেষ হলে বিরক্তিভরা চেহারায় বললেন, ‘ইউ আর আ শিট অ্যাকট্রেস!’ (তুমি জঘন্য অভিনেত্রী)

প্রথম আলোকে মনীষা বলেন, ‘ঠিক এভাবেই বলেছিলেন। সেদিনের পরিস্থিতিটা বলে বোঝানো যাবে না। যে অভিনয়কে এত ভালোবাসি, তা নিয়ে এমন কিছু শুনতে হবে, এটা মেনেই নিতে পারছিলাম না। আমি বিনোদকে অনেক অনুরোধ করি, আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। আরেকটা দিন সময় নিই।’

সেই এক দিনে কী করেছিলেন মনীষা? ‘বাড়ি ফিরে এসে শুরু করি প্র্যাকটিস। অডিশনের সেই লাইনগুলো বারবার আওড়াতে থাকি। কয় হাজার বার যে রিপিট করেছি, হিসাব নেই। মা আমাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কিচ্ছু খাইনি, ঘুমাইনি। এর আগে কখনো বুঝতেও পারিনি, একটা চরিত্রের জন্য, কয়েকটা লাইনের জন্য এতটা পরিশ্রম করতে পারব।’

পরদিন অডিশন হলো। বিধু বিনোদ সামনে এসে বললেন, ‘গতকাল তুমি ০ ছিলে, আজ ১০০-কেও ছাড়িয়ে গেছ।’

১৯৪২: আ লাভ স্টোরি ছবির দুই বেণি করা, শিফনের শাড়ি পরিহিত ‘রাজ্জো’ মনীষার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এরপর একে একে মনিরত্নমের বোম্বে, দিল সে..., মনসুর খানের আকেলে হাম আকেলে তুম, সঞ্জয়লীলা বানসালির খামোশির মতো ছবিতে অভিনয় করে গেছেন।

সাফল্যের টোটকা বলে দেন মনীষা, ‘জানেন, কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পেশা যা-ই হোক, কঠোর পরিশ্রমটা কিন্তু সব জায়গায় “কমন”। আমি সেটা পদে পদে টের পেয়েছি। এমনকি এখনো আমি একটা কিছু লেখার আগে, বলার আগে, অভিনয়ের আগে অনেক অনেক পরিশ্রম করি, অনুশীলন করি, পড়ি।’

ক্যানসার জয়

১০ ডিসেম্বর ২০১২। মনীষার জীবনের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ রাত। মৃত্যুভয় কী, একাকিত্ব কতটা ভয়ংকর, জীবনের মূল্য কত—ওই এক রাতে বুঝে যান মনীষা। জানতে পারেন, ক্যানসার ডিম্বাশয় (ওভারি) থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে। স্টেজ থ্রিতে বাঁচার সম্ভাবনা কেবল ৪৪ শতাংশ। নেপালের একটি হাসপাতালে ওই রাতটা একা কাটান মনীষা। ক্যারিয়ার তখন পড়তির দিকে, সংসারও ভেঙে গেছে।

বলিউডের এই অভিনেত্রী নিজের এই অভিজ্ঞতাগুলো বলছিলেন ১০ নভেম্বর, ঢাকা লিট ফেস্টের শেষ দিনে ‘হিলড’ নামের একটি সেশনে। ক্যানসার জয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে মনীষা একই নামে একটি বইও লিখেছেন। জানুয়ারিতে এটি বাজারে আসবে।

চিকিৎসার জন্য মনীষা নেপাল থেকে ভারতের মুম্বাই হয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। শুরুতেই অস্ত্রোপচার করে ডিম্বাশয় ফেলে দেওয়া হয়। আর কোনো দিন মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পারবেন না, এই বাস্তবতাও ধীরে ধীরে মেনে নিতে হয় মনীষাকে।

তাহলে এই কষ্ট নিয়েই জীবন কাটিয়ে যাবেন তিনি? মোটেই না। প্রথম আলোকে মনীষা বলেন, ‘অনেক ভুল আর অস্বাস্থ্যকর সময় পেরিয়ে এসে এখন জীবনের সেরা সময় কাটাচ্ছি আমি। মন চাইলে পাহাড়ে চলে যাই। কোনো দিন ছুটে যাই সাগরে। এভাবেই জীবনের প্রতিটা দিন আমি বাঁচি। যখন মনে হবে একজন সঙ্গী দরকার, মনে হবে আমার মতো কাউকে পেয়েছি, তখনই আমি সেসব নিয়ে ভাবব। আর কন্যাসন্তান দত্তক নেব বলে ভাবছি। তবে চূড়ান্ত কিছুই নয় এখনো।’

সঞ্জু ছবিতে নার্গিসের চরিত্রে মনীষা
সঞ্জু ছবিতে নার্গিসের চরিত্রে মনীষা

‘সঞ্জু’তে নার্গিস

সবশেষ অভিনয় করেছেন রাজকুমার হিরানির সঞ্জু ছবিতে, ক্যানসারে মারা যাওয়া ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী নার্গিসের চরিত্রে। যে কষ্ট পেরিয়ে গত ৬ বছর জীবন যাপন করছেন, পর্দায় আবার সেই যন্ত্রণাই তুলে ধরতে হয়েছে তাঁকে। মনীষা নড়েচড়ে বসেন, ‘ছবিটা করব কি না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন ছিল। যে যন্ত্রণাদায়ক পথ পেরিয়ে এসেছি, সেখানে আবার ফিরতে চাইছিলাম না। কিন্তু আমার পরিচালক আমাকে আশ্বস্ত করেন, এটাই তো অভিনয়। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে, সেখান থেকে শিখে, পর্দায় সেটা তুলে ধরার সুযোগ সবার হয় না। এটাই শিল্পীর কাজ।’

ঋতুপর্ণের চলে যাওয়া

মনীষা কৈরালা সুযোগ পেয়েছিলেন একটি মাত্র বাংলা ছবিতে অভিনয় করার। ছবির নাম খেলা (২০০৮)। প্রখ্যাত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ছিলেন পরিচালক। বাংলাদেশে এসে সেই বাংলা ছবির প্রসঙ্গও এল।

— খেলার পর আর কোনো বাংলা ছবিতে দেখা যায়নি আপনাকে।

— হ্যাঁ, আমি সৌভাগ্যবান। অন্তত একটা বাংলা ছবি তো করতে পেরেছি। তাও ঋতুপর্ণের মতো নির্মাতার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে আরও ছবি করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা পারলাম না। যখন আমার ক্যানসারের চিকিৎসা চলছিল, আমি জানতাম না বাঁচব কি না। সব দিকে, সবার মধ্যে একটু বাঁচার আশা খুঁজছিলাম। ঠিক সে সময় খবর পাই, ঋতুদা মারা গেছেন। খুব ভেঙে পড়েছিলাম।

মনীষা বললেন, ‘আমি আবার বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে চাই। সুযোগ পেলে, মনের মতো গল্প পেলে আমি বাংলাদেশে আবার আসব, অভিনয়ের জন্য।’