এসেছিলেন ষোলোতে, ফিরে গেলেন ছিয়াত্তরে

‘স্কুলে থাকতেই বাবার লেখালেখির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তাঁর লেখা প্রথম কবিতা কলকাতার “দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ক্লাস টেনে পড়ার সময় ঢাকার বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকায় বাবার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। লেখালেখির টানে বাবা যখন ঢাকায় স্থায়ীভাবে আসেন, তখন তাঁর বয়স ১৬। রাজধানী ঢাকায় কেটেছে বাবার ৬০ বছরের সংগ্রামী জীবন। একেবারেই সাদামাটা জীবন যাপন করেছেন। ৭৬ বছর বয়সে বাবাকে বিদায় জানিয়েছে ঢাকা। যে ঢাকার মানুষেরা ৬০ বছর আগে বাবার প্রতিভাকে স্বাগত জানিয়েছিল, আজ তাঁর ছেড়ে যাওয়ার সময় কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন বন্ধু-সহকর্মী-শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকে।’ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী ও লেখক আমজাদ হোসেনের জানাজা শেষে প্রথম আলোকে বললেন তাঁর ছোট ছেলে সোহেল আরমান।

এফডিসিতে আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ছবি: মনজুর কাদের
এফডিসিতে আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ছবি: মনজুর কাদের

আজ শনিবার বেলা আড়াইটায় চ্যানেল আইয়ের প্রজন্ম চত্বরে আমজাদ হোসেনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় এটিই ছিল তাঁর শেষ জানাজা। জানাজায় গান, নাটক আর চলচ্চিত্রের গুণী মানুষদের পাশাপাশি চ্যানেল আইয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। জানাজার আগে আমজাদ হোসেনকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ। এখান থেকে গুণী এই পরিচালকের মরদেহ নিয়ে পরিবারের সদস্যরা জামালপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। আগামীকাল রোববার সকাল ১০টায় জামালপুর শহরে বাবা নুরউদ্দিন সরকারের কবরে সমাহিত করা হবে আমজাদ হোসেনকে। মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও লেখক আমজাদ হোসেনকে দাফন করার কথা শোনা গেলেও গতকাল শুক্রবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায় আমজাদ হোসেনের পরিবার।

এফডিসিতে সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, সুষমাসহ অনেকে। ছবি: মনজুর কাদের
এফডিসিতে সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, সুষমাসহ অনেকে। ছবি: মনজুর কাদের

ঢাকায় শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে আমজাদ হোসেনের মরদেহ নিয়ে আসা হয় তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি)। চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘরে মরদেহ আনার খবরে চলচ্চিত্রের সর্বস্তরের মানুষ বন্ধু, অগ্রজ, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহকর্মীকে শেষবারের মতো দেখতে আসেন। কেউ কেউ আমজাদ হোসেনের মরদেহ দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। ষাটের দশক থেকে নিয়মিত এফডিসিতে আসা শুরু করেছিলেন লেখক, অভিনয়শিল্পী, পরিচালক ও গীতিকবি আমজাদ হোসেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় তাঁর কেটেছে এখানেই। এফডিসির প্রতিটি কোনায় কোনায় স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর। যত দিন সুস্থ ছিলেন, নিয়মিতই এফডিসিতে আসতেন। আজ দুপুরেও তিনি এলেন, কিন্তু একেবারে নিথর দেহে। কফিনে মোড়া আমজাদ হোসেনকে দেখে অনেকে নির্বাক ছিলেন। কয়েকটি সিনেমার শুটিং থাকলেও এফডিসি যেন কাঁদছে বরেণ্য এই পরিচালকের শেষ যাত্রায়।

আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। ছবি: মনজুর কাদের
আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। ছবি: মনজুর কাদের

নিথর আমজাদ হোসেনকে দেখতে এফিডিসি আজ লোকে লোকারণ্য ছিল। অনেক দিন পর এফডিসিতে এত মানুষের সমাগম দেখা গেল। এফডিসির ঝরনা স্পটের সামনে আমজাদ হোসেনের মরদেহ শেষবারের মতো দেখতে ভিড় করেন এ টি এম শামসুজ্জামান, সুচন্দা, আলাউদ্দিন আলী, ফারুক, ববিতা, আলমগীর, তপন চৌধুরী, চম্পা, ইলিয়াস কাঞ্চন, ফেরদৌস, রিয়াজ, পূর্ণিমা, আরিফিন শুভ, শেখ নজরুল ইসলাম, মুশফিকুর রহমান গুলজার, এস এ হক অলীক, সোহানুর রহমান সোহান, বদিউল আলম খোকন, জায়েদ খান, সাইমন, এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর হোসেনসহ চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থেকে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় আমজাদ হোসেনের মরদেহ বহনকারী বিমান ঢাকার মাটি স্পর্শ করে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ আনা হয় মোহাম্মদপুর বায়তুল আমান জামে মসজিদে। সেখানে জানাজা শেষে শেষবারের মতো আদাবরের বাড়িতে কিছুক্ষণ রাখা হয়। এরপর বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়। হিমঘর থেকে আজ শনিবার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমজাদ হোসেনের মরদেহ নিয়ে আসা হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত এই শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা বলেন, প্রয়াত পরিচালক ও লেখক আমজাদ হোসেন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। আমজাদ হোসেনকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস লেখা যাবে না। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র। তাঁর মৃত্যুতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তাঁদের বিশ্বাস, নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান তরুণেরাই সেই শূন্যতা পূরণ করবেন।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ছবি: মনজুর কাদের
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ছবি: মনজুর কাদের

শ্রদ্ধা জানাতে এসে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আমজাদ হোসেন একজন বড় চলচ্চিত্রকার ছিলেন। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রের ওপর কাজ করছেন। সব চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে শিক্ষামূলক একটা বক্তব্য তুলে আনতেন। তিনি একজন বড় মাপের লেখকও ছিলেন। আদর্শিক বিভেদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে কখনো আমাদের ব্যক্তিগত রেষারেষি হয়নি। আমাদের টেলিভিশন নাটকে আমজাদ হোসেনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁর নাটকে নানা অসংগতি উঠে এসেছে। তিনি তাঁর জায়গা তৈরি করে গেছেন। যে শূন্যতা তৈরি হলো, নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান তরুণেরাই সেটি পূরণ করবেন। চলচ্চিত্র, নাটক, তথা সৃষ্টিশীলতার জগতে তাঁরা অবদান রাখবেন।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘ষাট ও সত্তরের দশকে যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটছে, তখন আমজাদ হোসেনের লেখনী আমাদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। ষাটের শেষভাগে যখন তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়, বড় ভাইয়ের মতো স্নেহশীল একজন মানুষকে পেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ দেশে আমরা তাঁর অবস্থান জেনেছি, সেই সময়ের পরিস্থিতি তিনি সঠিকভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর নাটকে আনন্দের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরির চেষ্টা ছিল। বিষয়বৈচিত্র্য ও নাটকীয় পরিমিতবোধ মিলিয়ে তাঁর চলচ্চিত্রগুলো হয়ে উঠেছিল অনন্য। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, দেশপ্রেমিক ও সৃষ্টিশীল এই মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তাঁকে আমরা ভুলব না।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘আমজাদ হোসেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিরাট অবদান রেখে গেছেন। তাঁর চলে যাওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হলো, আশা করি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তা পূরণ করবে। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগটা অত গভীর নয়। আমজাদ গ্রামের মানুষকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, যার জন্য তাঁর চরিত্রগুলো অত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা, ছবিগুলোতে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ছাপ স্পষ্ট।’

নিথর আমজাদ হোসেনকে দেখতে এফিডিসি আজ ছিল লোকে লোকারণ্য। ছবি: মনজুর কাদের
নিথর আমজাদ হোসেনকে দেখতে এফিডিসি আজ ছিল লোকে লোকারণ্য। ছবি: মনজুর কাদের

আমজাদ হোসেনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে একটি প্যান্ডেলের নিচে আমজাদ হোসেনের কফিনে মোড়া মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হয়। একে একে বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণআজাদী লীগ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন, অভিনয় শিল্পী সংঘ, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ ৩২টি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ফুল দিয়ে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। আমজাদ হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের পর দুপুর সাড়ে ১২টায় তাঁর মরদেহ কারওয়ান বাজারের এটিএন বাংলা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় গত ১৮ নভেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আমজাদ হোসেনকে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। শুরু থেকেই তাঁকে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। বাংলাদেশের বরেণ্য এই নির্মাতার শারীরিক অসুস্থতার খবর শুনে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মাথায় তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমজাদ হোসেনের উন্নত চিকিৎসার খরচ বাবদ ২০ লাখ এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া বাবদ ২২ লাখ টাকা পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরেণ্য পরিচালক আমজাদ হোসেনকে ২৭ নভেম্বর রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকার পর ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে টানা ১৬ দিন চিকিৎসার পর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বেলা ২টা ৫৭ মিনিটে মারা যান কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী ও লেখক আমজাদ হোসেন।