দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় আর নেই

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়

‘এক দিন ফিরে যাব চলে

এ ঘর শূন্য করে
বাঁধন ছিন্ন করে
যদি চাহ যেও ভুলে।...’
সলিল চৌধুরীর লেখা আর সুর করা গানটি গেয়েছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। এই গানের কথাগুলোর মতোই তিনি চলে গেলেন সব বাঁধন ছিন্ন করে। আজ সোমবার দুপুরে কলকাতায় নিজ বাড়িতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের বাংলা ও হিন্দি গানের এই বরেণ্য সংগীতশিল্পী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে তখন জানানো হয়, তিনি ফুসফুসে সংক্রমণজনিত সমস্যায় ভুগছেন। পাশাপাশি রয়েছে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা। একটু সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে বঙ্গবন্ধু সম্মানে সম্মানিত করে।

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘আমি শোকস্তব্ধ। দ্বিজেনদা আর নেই। বাংলার সংগীতজগতে ইন্দ্রপতন হলো। দুঃখ প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছি।’

এদিকে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে কলকাতার সংগীতাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। লোপামুদ্রা মিত্র বলেছেন, ‘অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম৷ একে একে সিনিয়র শিল্পী যেভাবে চলে যাচ্ছেন, তাতে শূন্যতা বোধ করছি ৷ অনেককেই হারিয়ে ফেলছি৷ আসলে শেখানোর মানুষেরা ধীরে ধীরে সবাই চলে যাচ্ছেন৷ নানান অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যেই দেখা হতো৷ এবার সংগীত মেলায় তাঁকে খুব মিস করেছি৷’ আরতি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে তাঁকে চিনি ৷ তাঁর গান শুনেই বড় হওয়া৷ গানও করেছি একসঙ্গে৷ আমাকে খুব স্নেহ করতেন৷ আমার দেখা সবচেয়ে স্বচ্ছ ও শুভ্র মানুষ ছিলেন তিনি৷ আমার ছেলের মুখে ভাত অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি৷ আমার মুক্তা ভালো লাগে জেনে আমার ছেলের জন্য মুক্তার আংটি নিয়ে এসেছিলেন৷’ রূপঙ্কর বলেন, ‘খুব দুঃখের খবর৷ অসংখ্য গান গেয়েছেন৷ আমার মা দ্বিজেনবাবুর ছাত্রী ছিলেন। সেই সূত্রেই আলাপ৷ তাঁর চলে যাওয়া সংগীত জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’ রূপম ইসলাম বলেন, ‘দ্বিজেনবাবুর সংগীত নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি যা দিয়ে গেছেন, তা বাঙালির স্মৃতিতে চিরন্তন হয়ে থাকবে। আমার সৌভাগ্য, বারবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাঁর শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ পেয়েছি। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’

গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষ দিকে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের বন্ধুত্বের শুরু। সলিল চৌধুরীর হাত ধরেই হিন্দি ছবির গানে প্রবেশ করেন তিনি। এই জুটির কথা শ্রোতারা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। আজ বিকেলে দেবজ্যোতি মিশ্র বলেন, ‘খবরটা শোনার পর তাঁর একটা গান খুব মনে পড়ছে ৷ একদিন ফিরে যাব চলে...। আর মনে পড়ছে সলিল চৌধুরী ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব নিয়ে নানা কথা। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় খুব লম্বা ছিলেন আর সলিল চৌধুরীর উচ্চতা ছিল কম৷ তা নিয়ে সলিল চৌধুরী খুব রসিকতা করতেন। ইডেন গার্ডেনের পাশ থেকে যেতে যেতে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে নাকি তিনি বলতেন, মাথাটা উঁচু করে একটু দেখো তো, স্টেডিয়ামে কোনো খেলা হচ্ছে কি না!’

২০১০ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত করা হয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। ২০১১ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ‘বঙ্গবিভূষণ’। এ ছাড়া সাত দশকের বেশি সময়ের সংগীতজীবনে তিনি পেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস মেমোরিয়াল পুরস্কার (১৯৮২), ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার (১৯৯১), রাজীব গান্ধী পুরস্কার (১৯৯২), উত্তম কুমার জীবনকৃতী সম্মানসহ (২০০২) আরও নানা সম্মাননা। ২০১০ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট পান তিনি।

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২৭ সালের ১২ নভেম্বর। পেশাদার গায়ক হিসেবে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৪৪ সালে। মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রথম গান রেকর্ড করেন ১৯৪৫ সালে। প্রায় দেড় হাজার গান তিনি রেকর্ড করেছেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ৮০০। কিংবদন্তি সংগীতব্যক্তিত্ব সলিল চৌধুরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক অনবদ্য সৃষ্টি এবং গণনাট্য সংঘের হয়ে কাজ করেছেন তিনি। সুশান্ত লাহিড়ী, পঙ্কজ মল্লিক, শান্তিদেব ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে পৌঁছে দেয় অন্য উচ্চতায়। রবীন্দ্রসংগীত তো বটেই, বাংলা গানের জগতেও তিনি বরাবরই ছিলেন অনন্য।