মন্দের ভালো গান

আইয়ুব বাচ্চু
আইয়ুব বাচ্চু

কেমন ছিল ২০১৮ সালে আমাদের গানের জগৎটা? গানের মানুষ আমি, তাই দায়িত্ব পড়েছে এ নিয়ে লিখতে। এখন তো গান শোনার, দেখার অনেক মাধ্যম—এফএম রেডিও, অনলাইন সাইট, ইউটিউব, আই ক্লাউড (যাঁদের আইফোন আছে), টিভি, চলচ্চিত্র, মুঠোফোনসহ আরও কত কিছু। এর মধ্যে প্রায় সব মাধ্যমেই আমি গান শোনার এবং দেখার চেষ্টা করি। তার পরও অজান্তেই দু–একটি বিষয় বাদ পড়ে যেতে পারে। কারণ, পুরো এক বছরের পরিসংখ্যান তুলে ধরতে যে রকম গবেষণা করা দরকার, তা স্বল্প সময়ে সম্ভব হয়নি।

গানের প্রসঙ্গ ধরেই মনে পড়ছে, প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কাছে বছর কয়েক আগে জানতে চেয়েছিলাম, এই সময়ের গান কেমন হচ্ছে? উত্তরে বলেছিলেন, ‘এখন আর গানের সেই স্বর্ণযুগ নেই। ভালো গান হচ্ছে কই? এখনকার গান তো আস্তাকুঁড়ের পর্যায়ে নেমে এসেছে। স্মরণীয় গান হচ্ছে না। চেষ্টাটাও নেই।’ তিনি তখন আরও বলেছিলেন, ‘প্রতিভা হচ্ছে শ্রম দেওয়ার অনিঃশেষ ইচ্ছা। এটাকে সব সময় ধারের ওপর রাখতে হয়। ধার না দিলে মরচে পড়তে বাধ্য। আর গানটা হচ্ছে একই দেহে দুটি প্রাণ। কথা ও সুর মিলেই একটি গানের সৃষ্টি। সেই সৃষ্টির পেছনে ছোটাছুটিটাও এখন কম।’ কথাগুলো বলার কারণ, সৃষ্টির পেছনে ছোটার যে বিষয়টি তিনি বলেছেন, তা যেন এই সময়ে এসে অক্ষরে অক্ষরে মেলে।

প্রযুক্তির কল্যাণে এখন প্রকৃত শিল্পী আর বেসুরো শিল্পী এক হয়ে গেছেন। তাই একজন সৈয়দ আব্দুল হাদী বা সুবীর নন্দীর সঙ্গে আমরা এই প্রজন্মের গায়কদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিই। গুণগত মানের চেয়েও ‘লাইক’ ও ‘ভিউয়ার্স’–এর ওজন এখন অনেক বেশি। যে গান বা যে শিল্পী যত বেশি লাইক বা ভিউয়ার্স পাবেন, সেটাই সময়ের সেরা গান হিসেবে বিবেচ্য হয়ে যাচ্ছে প্রচারমাধ্যমে। প্রসঙ্গতই বলতে হয়, নবীন গায়ক আরমান আলিফের কথা; যাঁর গাওয়া, লেখা ও সুর করা ‘অপরাধী’ গানটি ২০ কোটি ‘ভিউ’ পাওয়ার পথে। সেই বিবেচনায় এ গান বছরের আলোচিত ও জনপ্রিয় গান। আবার তাঁর গাওয়া গানটি কভার সং হিসেবে গেয়েছেন আরেক নবীন গায়িকা টুম্পা খান, তিনিও আলোচিত। আবার এ গান জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলেরও কিঞ্চিত অবদান ছিল। যদিও গানের মানদণ্ডের বিচারে এটি ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ গানটির মতোই বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তবে ‘অপরাধী’ গানের জ্বরে দেশ ও দেশের বাইরের শ্রোতারা মাস ছয়েক ভুগলেও গত ১৮ অক্টোবর আমাদের ব্যান্ডসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর আকস্মিক মৃত্যু সেই জ্বর থেকে মুক্তি দিয়েছে সবাইকে। তাঁর মৃত্যুর পর চ্যানেলে চ্যানেলে, মঞ্চের যেকোনো অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ এবং তাঁর গাওয়া গানগুলো শ্রুত হচ্ছে বেশি। মৃত্যু তাঁকে পাহাড়সমান উঁচুতে তুলে দিয়েছে। আমরা বড্ড দেরিতে তাঁর মূল্যায়ন করতে শুরু করেছি। মৃত্যুর মিছিলে সংগীতাঙ্গনে এ বছর আমরা আরও যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে বছরের শুরুতেই হারিয়েছি গুণী শিল্পী শাম্মী আখতারকে। এরপর পপশিল্পী সাবা তানিকে। হারিয়েছি আরেক গুণী সুরকার আলী আকবর রূপুকে। হারিয়েছি কি-বোর্ডিস্ট তুষার এবং বেজ গিটারিস্ট সেন্টুকে।

ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে। এ বছর বিভিন্ন অডিও ভিজ্যুয়াল প্রতিষ্ঠান—গানচিল, ধ্রুব মিউজিক স্টেশন, সাউন্ডটেক, জি সিরিজ, লেজার ভিশন, বাংলার ঢোল, সংগীতা, সিএমভি, ঈগলস, সিডি চয়েস, সেভেন টিউনসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু ইউটিউবেই মুক্তি পেয়েছে চার শতাধিক গান (সঠিক হিসাব বের করা সম্ভব হয়নি)। এর অধিকাংশই মিউজিক ভিডিও আর বাকিগুলো লিরিক ভিডিও এবং অডিও আকারে এসেছে। আবার কিছু গান রয়েছে যেগুলো প্রথমে নাটকে, পরে নাটকের গানটিই আলাদা করে মিউজিক ভিডিও আকারে বেরিয়েছে।

এত গানের ভিড়ে ভালো-মন্দ বিচার করা কঠিনই বটে। নিজের বিচার যদি ভুল হয়, তাই কয়েকটি অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং এই অঙ্গনে সরাসরি জড়িত এমন কয়েকজনের মতামত জানতে চাইলাম। তাঁরাও এ বছর গান নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত নন। গীতিকবি আসিফ ইকবালকে জিজ্ঞেস করতেই কিছুটা বিব্রত তিনি। তবু বললেন, ‘ফিদা হয়ে যাওয়ার মতো কোনো গান পাইনি।’ তবে এ বছরের আলোচিত কয়েকটি গানকে তাঁরা ‘ঝাক্কাস’ বা ‘পার্টি সং’ নাম দিয়েছেন। এ রকমই আলোচিত একটি গান প্রতীক ও প্রীতম হাসানের ‘গার্লফ্রেন্ডের বিয়া’। আর বছরের মন্দের ভালোতে আসিফ ইকবালসহ সংগীতাঙ্গনের আরও কজন এবং অডিও প্রতিষ্ঠান থেকে যে গানগুলোর তালিকা মিলেছে, তার মধ্যে হাবিব-ফুয়াদের ‘চলো না’, ইমরানের ‘এমন একটা তুমি চাই’, মিনারের ‘কেন দিশেহারা’, তাহসান ও পূজার ‘একটাই তুমি’, মাহতিম শাকিবের ‘বুকের বাঁ পাশে’, বাপ্পা ও কোনালের ‘ঘুম জড়ানো’, এলিটার ‘কবি’, ফাহমিদা নবীর ‘চোখের কার্নিশে’, এফ এ সুমনের ‘মনটা আমার’, আসিফ ও কনার ‘মুছে দেব কান্না তোমার’, ধ্রুব গুহর ‘তোমার ইচ্ছে হলে’, প্রিয়াঙ্কা গোপের ‘ভুল’, শানের ‘বর্ষাবন্দনা’—এ রকম আরও কিছু গান। এই ভালো-মন্দের ভিড়ে কুমার বিশ্বজিতের কথা আলাদা করে না বললেই নয়। তিনিও যে চেষ্টা করেন ভালো কাজ করার, প্রমাণ রেখেছেন ‘বৃষ্টি এলেই আমার চোখে নেমে আসো তুমি’ গানে।

গানের মূল্যায়নে এ বছর চলচ্চিত্রের চিত্রটি হতাশজনক। প্রতিবছর ভালো কিছু গান পেলেও এ বছর সেই জায়গাটা প্রায় শূন্যের পর্যায়ে। তারপরও বেশি ‘ভিউ’ পাওয়া রাফাত ও ঐশীর ‘চিটাগাইঙ্গা পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ গানটিকে অনেকেই ভালো গান নয়, ফেলেছেন ‘ঝাক্কাস’ গানের তালিকায়। এর বাইরে যে গানগুলো আলোচনায় এসেছে, তার মধ্যে কনা ও ইমরানের গাওয়া পোড়া মন ২ ছবির ‘ওহে শ্যাম’, দেবী ছবিতে মমতাজের গাওয়া ‘দোয়েল পাখি’, পোড়ামন ২-এ নদীর গাওয়া ‘সুতোকাটা ঘুড়ি’র কথা বলা যায়। শেষ গানটি লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, যিনি এই সময়ে এসেও প্রমাণ করেছেন তাঁর কাব্যগুণসমৃদ্ধ লেখার ধার কত।

এবার চ্যানেলের দিকে তাকালে দেখি, গাননির্ভর অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করার মতো নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। চ্যানেল আইয়ের উদ্যোগে প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ‘সেরা কণ্ঠ সিজন-৬’ শেষ হলো এ বছর। সেরা কণ্ঠ হয়েছেন যৌথভাবে ঐশী ও সুমনা। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রতিযোগিতা নিয়ে এখন আর আগের মতো উচ্ছ্বাস নেই কারও। অনেক সংগীতবোদ্ধার মতে, এ জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী।

‘গানবাংলা’র ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’, সিজন-থ্রির এবারের আয়োজনে দুটো গানের কথা আলোচনায় এসেছে। একটি মান্নান মোহাম্মদের ‘বেইমান পাখি’ এবং মিজানের কণ্ঠে আজম খানের ‘পাপড়ি কেন বোঝে না’। তবে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দেশীয় সংগীতের এই মেলবন্ধন আমাদের গানে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

শুধু ‘ভিউয়ার্স’ আর ‘লাইক’সমৃদ্ধ নয়, নতুন বছর মানসম্পন্ন ভালো কিছু গান পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে লেখাটি শেষ করছি।

লেখক: গীতিকবি