শুটিংয়ের ফাঁকে দেবের সঙ্গে

দেব  ছবি: খালেদ সরকার
দেব ছবি: খালেদ সরকার

বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া দুইটা। রাজধানীর একটি হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন খুব পরিচিত কেউ। তিনি দেব। ভারতের বাংলা ছবির এই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক। এখানে কী করছেন তিনি? হোটেলের বাইরে একা দাঁড়িয়ে আছেন! না, আসলে এখানে ছবির শুটিং হচ্ছে। এ দেশের কোনো ছবি নয়, কলকাতার ছবি। নাম বুনোহাঁস। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটি পরিচালনা করছেন অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী।
এগিয়ে এলেন পরিচালক। স্বাগত জানিয়ে ক্যামেরার পেছনে নিয়ে দাঁড় করালেন। অনুরোধ করলেন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য।
হোটেলের বাইরে থেকে এক যুবক এসে ঢুকলেন। মনে হলো, তিনি কিছু খুঁজছেন। এটুকুই শট। ১০ মিনিটেই ওকে। এবার দেবের সঙ্গে কথা বলার পালা।
দেব বললেন, ‘চলুন, আমার রুমে গিয়ে বসি।’
কথা শুরু হলো লিফটের ভেতরেই। কেমন লাগছে? ‘খুব ভালো। ফাটাফাটি।’ বলেন দেব।
রুমে বসেই দেব বলেন, ‘বাংলাদেশে এসেছি চার দিন হলো। কাল (শুক্রবার) চলে যাব। ইচ্ছা ছিল আরও কিছুদিন থাকার। কিন্তু উপায় নেই, শনিবার থেকে জি-বাংলার ড্যান্স বাংলা ড্যান্স-এর শুটিং। তিন দিন পর ছুটতে হবে হায়দরাবাদ।’
ড্যান্স বাংলা ড্যান্স অনুষ্ঠানে তিনি ক্যাপ্টেন দেব। এরই মধ্যে এই অনুষ্ঠানে তাঁর একটি সংলাপ দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে, ‘ফাটাফাটি জমে ক্ষীর, পারফরম্যান্স জমে চৌচির’। সংলাপটির কথা তুলতেই হাসলেন দেব। বললেন, ‘আমি নিজে যেহেতু তরুণ, উপস্থাপনায় তারুণ্যের ব্যাপারটা রাখতে চেয়েছি।’
নিজের শুটিং দেখার কথা দেব বললেন এভাবে, ‘বাবা তো সিনেমার লোক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই শুটিং দেখে দেখে বড় হয়েছি। কেন জানি যেখানেই ক্যামেরা দেখতাম, দাঁড়িয়ে যেতাম। তবে বাংলাদেশে শুটিং দেখতে যে মানুষের সমুদ্র চলে আসবে, তা ভাবিনি।’

দেব  ছবি: খালেদ সরকার
দেব ছবি: খালেদ সরকার

দেব কম্পিউটার প্রকৌশলী। পড়াশোনা শেষ করে ২০০৫ সালে প্রথম যে চাকরি পেয়েছিলেন, তার বেতন ছিল ৩০ হাজার রুপি। কিন্তু কারও অধীনে চাকরি করতে চাননি তিনি। বাবা-মায়ের অমতে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে ছিলেন আব্বাস মস্তানের সহকারী। ছবির নাম টারজান দ্য ওয়ান্ডার কার। এই কাজটাই পছন্দ হয়ে গেল।
দেব বললেন, ‘ভালোই তো, কিছুই করতে হয় না। হিরোদের কত আরাম, এসি ভ্যানে বসে থাকে। সুন্দর সুন্দর নায়িকাদের সঙ্গে গান গায়, নাচে। বিনা খরচে এত এত জায়গায় ঘুরতে পারে। অটোগ্রাফ দেয়। এটাই আমাকে করতে হবে। এটাই ভালো পেশা। এভাবেই থেকে গেলাম ছবির জগতে।’
শুরুটা মুম্বাইয়ে হলেও দেব সেখানে গিয়ে কোনো ছবিতে অভিনয় করতে চান না। বললেন, ‘মুম্বাইয়ের ছবির ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি বাংলা ছবি করে খুব সন্তুষ্ট। বাংলা ছবির অনেকটা দায়িত্ব আমার কাঁধে চলে এসেছে। আমি যদি এখন ছয় মাস মুম্বাইকে দিয়ে দিই, তাহলে এখানে কী হবে? আমার ওপর নির্ভর করে অন্তত ৫০০ প্রেক্ষাগৃহ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কথাও আমাকে ভাবতে হচ্ছে। বড় হলে দায়িত্বও অনেক বেড়ে যায়। এখন টাকার খুব একটা লোভ নেই। কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও নেই। আমার যা দরকার, তা পেয়ে গেছি। এখন শুধু এটা ধরে রাখতে চাই।’
পর্দায় নায়ক সব পারেন, ব্যক্তিজীবনে দেব কী পারেন? ‘কিছুই পারি না। কাজ করি। চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ি। নিজের ছবিগুলো দেখি।’ বললেন দেব।
দেব এখন খুব ব্যস্ত। নিজের পরিবারের সঙ্গে কতটা সময় দেন তিনি? দেব বললেন, ‘বাড়িটা হয়ে গেছে আমার স্যুটকেস। ছবিতে এসেছি নয় বছর হলো। এই পুরো সময়টায় আমার তো ঘুরে ঘুরেই কাটছে। তবে অভিনয় আমার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো পেশা। কারণ, কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে। তাঁরা আমাকে দেখছেন। তাঁরা আমাকে চেনেন না, জানেন না, শুধু পর্দায় দেখে ভালোবাসছেন। আমার জন্য কাঁদেন, প্রার্থনা করেন, উপোস করেন। এমনটা আর কোনো পেশায় আছে?’
এবার বুনোহাঁস ছবির প্রসঙ্গ। দেব বললেন, ‘বুনোহাঁস ছবির গল্পটা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। গল্পে গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে বাংলাদেশ। কাজটা আমরা কলকাতায় করতে পারতাম, কিন্তু বাংলাদেশকে বাদ দিতে চাইনি। গল্পে যে জায়গাগুলোর উল্লেখ আছে, আমরা সেখানেই গিয়েছি।’
তখন রুমে এসে ঢুকলেন ছবির ইউনিটের একজন। জানালেন, হাজির বিরিয়ানি এসে গেছে। শুনেই দেবের মুখ হাসিতে ভরে গেল। কিন্তু দরজায় নিজের প্রশিক্ষককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন যেন চুপসে গেলেন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আমি ঢাকায় আসার আগে অনেকেই বলেছেন, “যাও, দুই দিনেই মোটা হয়ে ফিরবে।” কিন্তু তার উপায় নেই। সামনে আমাকে দক্ষিণের মাগাধিরা ছবির বাংলা রিমেকে কাজ করতে হবে। এর জন্য সিক্স প্যাক শরীর বানাতে হবে। ঢাকায় এসেও শুটিংয়ের ফাঁকে সকাল-বিকাল ব্যায়াম করতে হচ্ছে। খেলে তো চলবে না।’
বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শুটিং করেছেন দেব। বললেন, ‘অনেক জায়গায় ঘুরেছি। জায়গার চেয়ে এ দেশের মানুষকে বেশি ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়, একটা জায়গার পরিচয় হলো সেখানকার বাসিন্দারা। বাংলাদেশের মানুষের উষ্ণ অভ্যর্থনার কথা কখনো ভুলব না।’
বাসার সবার কাছে দেব হলেন রাজু। দীপক অধিকারী রাজু। কিন্তু দেব কখনোই রাজু হতে চান না। বললেন, ‘ছবির জায়গাটা আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই না। বাবা মুম্বাই থাকতেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, অনেকের সঙ্গে অশান্তি করে, মুম্বাই ছেড়ে কলকাতায় এসে থেকেছি। সংগ্রাম করেছি। এই কাজটা আমি উপভোগ করতে চাই।’
দেব আরও বললেন, ‘নায়ক না হলে সহকারী পরিচালক হয়েই থেকে যেতাম।’
ড্যান্স বাংলা ড্যান্স অনুষ্ঠানের মহাগুরু ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। এই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আগে তাঁর কাছে পরামর্শ চান দেব। মিঠুন তাঁকে বলেছিলেন, ‘কোনো ভাব দেখাবি না। তুই মাটির ছেলে, একদম মাটির মতোই থাকবি। ঠিকই তো, ভাব দেখাব কার সঙ্গে? অনেক কষ্ট করে আজকের অবস্থানে এসেছি। এই জায়গাটা আমাকেই ধরে রাখতে হবে। আর ভাব ব্যাপারটা আমাকে দিয়ে হয় না।’
সম্প্রতি প্রয়াত সুচিত্রা সেনের কথা উঠতেই দেব বললেন, ‘তাঁকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। সেই সুযোগটা পেয়ে যাই তাঁর মৃত্যুর পর। শ্মশানঘাটে আমরা মাত্র ১০ জন সুচিত্রা সেনের মুখ দেখতে পেরেছিলাম। অভিনয়ে না এলে এই সুযোগটা কি পাওয়া যেত?’
বিদায় নেওয়ার সময় দেব বললেন, ‘বাংলাদেশের ছবিতে অভিনয় করব। এই ইচ্ছাটা নিয়েই এবার ফিরে যাচ্ছি।’