প্রথা ভাঙার আসরে অস্কার 'সবার'!

রামি মালেক, অলিভিয়া কোলম্যান, রেজিনা কিং ও মাহেরশালা আলী। ছবি: একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
রামি মালেক, অলিভিয়া কোলম্যান, রেজিনা কিং ও মাহেরশালা আলী। ছবি: একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

শিল্পের জগতে অস্কার বা একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস সব সময়ই ‘কুলীন’। তাবৎ বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী ও পরিচালকদের কাছে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতির সর্বোচ্চ ধাপ অস্কারের সোনালি ট্রফি। অন্য কোনো পুরস্কার কপালে না জুটলেও, অস্কার পেলে তা পেয়ে যায় ‘সব পেয়েছি’র তকমা। কিন্তু এই অস্কার কয়েক বছর ধরে তার যশ হারাচ্ছিল। গত আসরে এর দর্শকপ্রিয়তা যেমন কমে গিয়েছিল, তেমনি দিনকে দিন নানা বিতর্কের জালে জড়াচ্ছিল একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস।

প্রথম প্রতিযোগিতামূলক অস্কার জিতে উচ্ছ্বসিত পরিচালক স্পাইক লি। ছবি: রয়টার্স
প্রথম প্রতিযোগিতামূলক অস্কার জিতে উচ্ছ্বসিত পরিচালক স্পাইক লি। ছবি: রয়টার্স

তবে সব সংশয় দূর করে এবার সর্বজনীন হয়েছে অস্কার। ৯১তম আসরের মনোনয়নেই প্রথা ভাঙার ইঙ্গিত ছিল, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তা পূর্ণতা পেয়েছে। স্রেফ বাণিজ্যিক ধারার ধুন্ধুমার অ্যাকশন ছবি যেমন এ দিন ট্রফি জিতেছে, তেমনি শৈল্পিক সৌন্দর্যের স্বীকৃতিও মিলেছে। এ বছর অস্কার কোনো লিঙ্গ, বর্ণ বা জাতির হয়ে থাকেনি, বিখ্যাত নামের মোহে বাঁধা পড়েনি। বরং অস্কার হয়েছে সবার, যা পেতে কাউকে ‘কুলীন’ হতে হয় না!

অস্কারের মনোনয়নের চমক ছিল। প্রথমবারের মতো সুপারহিরো ছবি হিসেবে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ এবার মনোনয়নের তালিকায় ছিল। যে নেটফ্লিক্সকে হুমকি হিসেবে নিয়ে হলিউড নানা সময় বিদ্রূপের তির ছুড়েছে, তাদের ছবি ‘রোমা’ ছিল পুরস্কার পাওয়ার দৌড়ে। সেদিক থেকে মনোনয়নের তালিকা প্রকাশের পরই অস্কারের রেকর্ড বুকে ঘটে যায় ওলট-পালট। চমকের ধারা শেষ পর্যন্ত ধরে রেখেছে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস কর্তৃপক্ষ।

সঞ্চালকবিহীন এই আসরে সেরা ছবির অস্কার জিতেছে ‘গ্রিন বুক’। প্রথম চমক এটিই ছিল। এই ছবির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ‘রোমা’, ‘দ্য ফেভারিট’, ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’, ‘ব্ল্যাককক্লানসম্যান’, ‘ভাইস’, ‘বোহেমিয়ান রাপসোডি’ ও ‘আ স্টার ইজ বর্ন’। বিষয়বস্তুর দিক থেকে কোনো ছবিরই বৈচিত্র্যের অভাব ছিল না। সমালোচকদের বিচারে এগিয়ে ছিল ‘রোমা’, ‘দ্য ফেভারিট’-এর মতো ছবিগুলো। কিন্তু সবাইকে টপকে অস্কার জিতে নেয় মার্কিন মুলুকের বর্ণবাদের পটভূমিতে তৈরি কমেডি ধারার ‘গ্রিন বুক’। ছবিটি নিয়ে অবশ্য কিছুটা বিতর্কও আছে। এক মেধাবী কৃষ্ণাঙ্গ পিয়ানোবাদক ও তাঁর শ্বেতাঙ্গ গাড়িচালকের জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ছবির গল্প। যাঁকে নিয়ে ছবির গল্প, তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছবিটির বিরুদ্ধে বক্তব্যও দিয়েছেন। কিন্তু একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বর্ণবাদ নিয়ে ছবিটির বক্তব্য অগ্রাহ্য করতে পারেনি।

একই ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে সেরা পার্শ্ব অভিনেতার স্বীকৃতি পেয়েছেন মাহেরশালা আলী। এর ফলে ডেনজেল ওয়াশিংটনের পর দ্বিতীয় কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে একটির বেশি অস্কার ট্রফি জিতলেন আলী। এর আগে ‘মুনলাইট’ ছবিতে অভিনয় করে অস্কারের হালখাতা খুলেছিলেন তিনি।

একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে লেডি গাগা ও অভিনেতা ব্র্যাডলি কুপার। এবারের আসরে গান গেয়ে অস্কারও জিতেছেন লেডি গাগা। ছবি: রয়টার্স
একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে লেডি গাগা ও অভিনেতা ব্র্যাডলি কুপার। এবারের আসরে গান গেয়ে অস্কারও জিতেছেন লেডি গাগা। ছবি: রয়টার্স

সেদিক থেকে সেরা অভিনেতার যুদ্ধে প্রকৃত যোদ্ধা কমই ছিল। ‘ভাইস’ ছবির জন্য পুরস্কারের দৌড়ে ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান বেল। কিন্তু কিংবদন্তি রক ব্যান্ড ‘কুইন’-এর লিড ভোকাল ফ্রেডি মার্কারির কাছে হেরে গেলেন সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি! ফ্রেডি মার্কারি হয়ে রুপালি পর্দা কাঁপিয়ে অস্কার জিতে নিয়েছেন রামি মালেক (বোহেমিয়ান রাপসোডি)। ফ্রেডি মার্কারি ছিলেন একজন সমকামী, একজন অভিবাসী—যিনি মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশের মাটিতে বড় হয়ে কাঁপিয়েছিলেন বিশ্বসংগীতের মঞ্চ। তাঁর সেই সংগ্রামের গল্প, নিজের পরিচয় খোঁজার গল্পকেই স্বীকৃতি দিল অস্কার। এই ছবি জিতেছে আসরের সবচেয়ে বেশি, চারটি ট্রফি। আর কে না জানে, যুদ্ধ বাধানোর গল্পের চেয়ে মানুষের দ্বন্দ্বমুখর জীবনের গল্পই দর্শকদের কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ তাতেই পাওয়া যায় বেঁচে থাকার আশা।

এবারের অস্কারে নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্যামেরার সামনে ও ক্যামেরার পেছনে—সবখানেই নারীদের জয়গান দেখা গেছে। যৌন হয়রানির অভিযোগে জর্জর হলিউডের বিতর্ক ঝেড়ে ফেলতে এর প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে কঠিন লড়াই হয়েছে সেরা অভিনেত্রী বিভাগে। ‘দ্য ওয়াইফ’ ছবিতে এক নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের স্ত্রীর চরিত্রে গ্লেন ক্লোজ অনবদ্য ছিলেন। পিছিয়ে ছিলেন না ইংল্যান্ডের রানির চরিত্রে অভিনয় করা অলিভিয়া কোলম্যান। সমকামী ও সন্তানহারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক উদভ্রান্ত নারীর চরিত্রকে সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সাহিত্যিকের স্ত্রীকে হারিয়ে দিয়েছেন ইংল্যান্ডের রানি। কেট উইন্সলেটের পর দ্বিতীয় ব্রিটিশ অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার জিতেছেন অলিভিয়া কোলম্যান। আর এবারও শিকে না ছেঁড়ায় নতুন রেকর্ডে নাম লেখালেন গ্লেন ক্লোজ। এ নিয়ে মোট সাতবার অস্কার মনোনয়ন পেলেও, তিনি ঘরে নিতে পারলেন না সোনালি ট্রফি।

সেরা অভিনেতার ট্রফি হাতে রামি মালেক। ছবি: এএফপি
সেরা অভিনেতার ট্রফি হাতে রামি মালেক। ছবি: এএফপি

সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে স্বীকৃত হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ রেজিনা কিংয়ের অভিনয় (ইফ বিয়েল স্ট্রিট কুড টক)। অন্যদিকে প্রথম আফ্রো-আমেরিকান নারী হিসেবে প্রথমবারের মতো কস্টিউম ডিজাইন বিভাগে সেরা হয়েছেন রুথ ই. কার্টার (ব্ল্যাক প্যান্থার)। অস্কার হাতে নেওয়ার পর শুরুতেই তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ পরিচালক স্পাইক লি-কে। কার্টারের ভাষায়, এই ভদ্রলোকই প্রথম জানান দিয়েছিলেন যে অভিনয় বাদে সৃষ্টিশীল কাজ দিয়েও দুনিয়া মাত করতে পারে কৃষ্ণাঙ্গরা। স্পাইক লি-র অপেক্ষাও এবার শেষ হয়েছে। এর আগে সম্মানসূচক অস্কার জিতলেও কখনো প্রতিযোগিতায় স্বীকৃতি পাননি তিনি। ‘ব্ল্যাককক্লানসম্যান’ ছবির চিত্রনাট্য লিখে এবার সেই শূন্যস্থান পূরণ হলো। অ্যাডাপ্টেড স্ক্রিনপ্লে বিভাগে অস্কার পেয়েছে ‘ব্ল্যাককক্লানসম্যান’। আবার অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে বিভাগেও পুরস্কার জিতেছে বর্ণবৈষম্য-বিষয়ক ছবিই, ‘গ্রিন বুক’।

ওদিকে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ ছবিতে প্রোডাকশন ডিজাইনের কাজ করে যৌথভাবে অস্কার জিতেছেন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হান্নাহ বিচলার। কার্টার ও বিচলারের এই অর্জন নানা দিক থেকে ঐতিহাসিক। কেননা গত ৩০ বছরে অভিনয় বাদে অন্য সৃষ্টিশীল কাজে অবদানের জন্য কোনো আফ্রো-আমেরিকান নারীই অস্কার জয় করতে পারেননি। আর এবার এক আসরেই তা করে দেখালেন দুজন!

সেরা পার্শ্ব অভিনেতার অস্কার হাতে মাহেরশালা আলী ও সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী রেজিনা কিং। ছবি: এএফপি ও রয়টার্স
সেরা পার্শ্ব অভিনেতার অস্কার হাতে মাহেরশালা আলী ও সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী রেজিনা কিং। ছবি: এএফপি ও রয়টার্স

নেটফ্লিক্সের ছবি আদৌ পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র কি না—এ নিয়েই অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। হলিউডের অনেক রথী-মহারথীরা বলছিলেন, শৈল্পিক মানে ঢের পিছিয়ে নেটফ্লিক্স। সব সমালোচনার উত্তর দিল ‘রোমা’। আলফনসো কুয়ারনের এই ছবি তিনটি বিভাগে অস্কার জিতেছে। সেরা পরিচালক ও সেরা সিনেম্যাটোগ্রাফার হয়েছেন কুয়ারন। সেরা বিদেশি ভাষার ছবি হয়েছে ‘রোমা’। স্প্যানিশ ভাষার সাদাকালো এই ছবি চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ছবি হিসেবে এরই মধ্যে সমালোচকদের স্বীকৃতি পেয়ে গেছে।

সুপারহিরোদের ছবি শুধু পয়সা রোজগারের জন্য—এই আপ্তবাক্যও এবার মিথ্যে করে দিয়েছে মার্ভেল। কমিক চরিত্র ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ দিয়েই ঘরে নিয়েছে তিনটি ট্রফি। মনোনয়নেই গড়া ইতিহাস অবশেষে চিরস্থায়ী হলো। এবার ডিসি-মার্ভেলের অন্যান্য সুপারহিরোদের চ্যালেঞ্জ ছুড়েই দিতে পারে কৃষ্ণাঙ্গ অতিমানব ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’!

শেষ পর্যন্ত জিতেছেন ইংল্যান্ডের রানি! এমন চরিত্রে অভিনয় করেই অস্কার পেয়েছেন অলিভিয়া কোলম্যান। ছবি: এএফপি
শেষ পর্যন্ত জিতেছেন ইংল্যান্ডের রানি! এমন চরিত্রে অভিনয় করেই অস্কার পেয়েছেন অলিভিয়া কোলম্যান। ছবি: এএফপি

লস অ্যাঞ্জেলসের ডলবি থিয়েটারের মঞ্চ এবার তাই অনেক বৈচিত্র্যের সাক্ষী হয়ে রইল। উঠে এল নারী, বর্ণবৈষম্য ও অভিবাসী প্রসঙ্গ, দেওয়া হলো স্বীকৃতি। বিনোদন জগতের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতির মঞ্চে এভাবেই গাওয়া হলো জীবনের জয়গান।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্ট, মিরর, নিউইয়র্ক টাইমস, ভ্যারাইটি, ব্লুমবার্গ, হলিউড রিপোর্টার ও ফক্স নিউজ