খোলা খাতা কেউ পছন্দ করে না

>

টেলিভিশনের ‘গহরগাছি’ নাটকে অনবদ্য অভিনয় করে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন নাজনীন হাসান চুমকী। মঞ্চে অভিনয় করেছেন ‘নিত্যপুরাণ’ আর ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’ নাটকে। তিন দশক ধরে মঞ্চ আর টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ সময়ের মধ্যে অভিনয় করেছেন, নাটক লিখেছেন, পাশাপাশি পরিচালনাও করেছেন। সম্প্রতি কাজ শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন তিনি।

নাটক নির্মাণ করছেন না কেন?
নির্মাণ প্রায় ভুলতে বসেছি। নাটক নির্মাণে বাজেট দরকার, যোগ্য শিল্পী দরকার। নিজের প্রয়োজনমতো শিল্পী যেমন পাচ্ছি না, তেমনি পর্যাপ্ত বাজেটও পাচ্ছি না। টাকা না থাকলে চরিত্রের প্রয়োজনে যাকে দরকার, তাকে নেওয়া যায় না। অন্যদের দিয়ে হয়তো করা যাবে, কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ।

নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার
নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার


এত দিন যে কাজগুলো করলেন, সেগুলোর বাজেট পর্যাপ্ত ছিল?
এত দিন যেসব কাজ করেছি, সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যদের পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পরিচালক হিসেবে নিজের পারিশ্রমিক পাইনি। কারও কাছ থেকে চিত্রনাট্য নিলে তাদের সম্মানী দিতে হয়, কিন্তু নিজে লিখলে সম্মানী নিতে পারি না।

তাহলে নাটক পরিচালনা করে লাভ কী হলো?
ভালো লাগা। আমি কাজ করতে ভালোবাসি, লিখতে ভালোবাসি। নিজের লেখা প্রাণ পাচ্ছে, সেটা দেখতেই ভালো লাগে। এখন অবশ্য পরিচালনার কাজ বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে।

পরিচালনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলেন কেন?
আমি থিয়েটারের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করতাম। সেটা কেবল অভিনয় নয়, কস্টিউম বা সেটের কাজ বা তত্ত্বাবধান, যেকোনো কিছু। থিয়েটার জায়গায়টা এমন যে, এখানে মনের মিল না থাকলে একসঙ্গে কাজ করা যায় না। যাদের সঙ্গে কাজ করতাম, তাদের সবার সঙ্গে মনের মিল ছিল। সে জন্য কখনোই ভাবতে হয়নি, আমাকে টিভিতে কাজ করতে হবে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে আমাকে টিভি আর সিনেমায় কাজ করতে হয়েছে। এগুলোর কোনোটাই প্ল্যান করে হয়নি। একটা কাজই প্ল্যান করে করেছিলাম, সেটা হচ্ছে পরিচালনা। আমার জানা ছিল, মিডিয়ায় কাজের ক্ষেত্রে একটা সময় আমাকে থামতে হবে। সেটা আমার বয়সের কারণে। তখন কী করব? বসে তো থাকব না। সেই চিন্তা করেই ডিরেকশনে এসেছিলাম। কর্মক্ষেত্রে মানুষের যেমন পদোন্নতি হয়, তেমনি এটাকেও আমি একরকম পদোন্নতি হিসেবে দেখি। কারণ বয়স বাড়লে আমাকে চিন্তা করে তো কেউ নাটক লিখবে না। আমিও সব চরিত্রে অভিনয়ের যোগ্য নই।

নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার
নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার


পাশের দেশে কিন্তু সব বয়সী নারীদের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা যায়। ‘বাহুবলি’ ছবিতে রম্য কৃষ্ণার কথাই ধরা যাক, তাঁর বয়স ৪৮ বছর। কিংবা এ বছর অস্কার পাওয়া ব্রিটিশ অভিনেত্রী অলিভিয়া কোলম্যানের বয়স ৪৫ বছর। আমাদের দেশে তাহলে গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্রে রাখা হয় না কেন?
আমাদের নির্মাতাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বাইরের ছবিগুলো হিট হচ্ছে কীভাবে? এই ধরুন কলকাতার সিনেমাগুলো দেখছি। আমরা দেখছি, কাঁদছি, হাসছি, আলোচনা করছি, রিভিউ লিখছি, স্ট্যাটাস দিচ্ছি, অন্যকে দেখতে বলছি। অথচ প্রযোজক বা চ্যানেলকে ওই ধরনের কোনো কনসেপ্ট দিলে তারা বলে, এই সব মানুষ দেখে না। বাড়িতে গিয়ে তিনি নিজেই কিন্তু ‘বেলাশেষে’ বা ‘পোস্ত’র মতো ছবিগুলো দেখেন।

প্রায় সাত বছর বিরতি দিয়ে মঞ্চে ফিরলেন। এসে কী দেখলেন?
২০১০ সালের শেষ দিকে এসে দেখি প্রাচ্যনাট চমকে দেওয়া প্রযোজনা নিয়ে এসেছে। তারও আগে ‘সার্কাস সার্কাস’ দেখে মনে হলো স্বপ্নের মতো কিছু দেখছি। প্রাচীদি, প্রাণদা, খুশি আপা, বৃন্দাবনদা, লিটু ভাইসহ অনেকে ছিলেন সেখানে। যেভাবে তাঁরা পারফরম করলেন, তথাকথিত থিয়েটারের বাইরে বেরিয়ে যে সংলাপের প্যাটার্ন—সবকিছু পাভেল ভাই বদলে দিলেন। বটতলাও বদল এনেছিল। ‘রিজওয়ান’ নাটকটার কথাও বলতে হয়, অনেক জাদুকরী। সিএটি দলটিও। থিয়েটারে দৃষ্টিভঙ্গি আর সাহসের মধ্যে একধরনের ফাইট চলছে।

আপনাকে কোনো টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানপ্রধানের দায়িত্ব দিলে কী করবেন?
সবার আগে নাটকের গল্প বদলে দেব। কখনো ভারতের সিরিয়ালগুলো দেখি না। কারণ সেগুলো আমাকে টানে না। আমার অনেক সহকর্মী দেখেন। আমাদের গৃহপরিচারিকা পর্যন্ত ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর ভুল ধরে। কিন্তু ঠিকই বসে বসে দেখে। সেগুলো ওদের টানে, কারণ বেশির ভাগ কাজ পরিবারকেন্দ্রিক, মানুষকেন্দ্রিক। সেখানে মানুষের নানা সংকট আর পারিবারিক বন্ডিং দেখানো হয়। যদিও সেগুলো অনেক একঘেয়ে। আমরা যেসব ৪০ মিনিটে দেখাই, তারা সেগুলো ৪০ পর্বে টেনে নিয়ে যায়। এত দীর্ঘ বিরক্তিকর জিনিসও উপভোগের কারণ, দর্শক পরিবারের গল্প দেখতে পছন্দ করে। নিজের পারিবারিক সংকটগুলোর সঙ্গে সেগুলোকে মেলাতে চায়, সমাধান দেখতে চায়। নিজের সংসারের সমস্যাগুলো কাউকে বলতে পারে না। কিন্তু টেলিভিশনে দেখে একধরনের শান্তি অনুভব করে। আমাদের টেলিভিশনে আছে কেবল প্রেম আর ভালোবাসা।

নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার
নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার


এত টিভি চ্যানেলের জন্য গল্প লেখার মতো গল্পকার আছে এ দেশে?
এখন তো গল্পকারই নেই। আমি আগে নাটক লিখতে শুরু করি, পরে নির্মাণে আসি। ২০০২ থেকে লেখা শুরু করি, ২০০৩ থেকে নির্মাণ শুরু হয় আমার নাটক।

আপনার প্রিয় নির্মাতা কে?
আমার পরিচালকদের মধ্যে সবাই খুব ভালো। তবে বিশেষভাবে সুমন আনোয়ার, গোলাম সোহরাব দোদুল, সালাহউদ্দিন লাভলুর কথা বলতে হয়। লাভলু ভাই তো জাদু জানতেন। যখন চরিত্র বুঝিয়ে দেন, এমনভাবে বুঝিয়ে দেন, যেন ভেতর থেকে টেনে বের করে আনতেন। টিভিতে আমার দ্বিতীয় কাজটা ছিল সালাহউদ্দিন লাভলুর প্রথম পরিচালনা। তিনি সেটার সিনেমাটোগ্রাফারও ছিলেন। নাম ‘গহরগাছি’।

নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার
নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার


আপনার পরিচালক হওয়ার পেছনে তাঁদের উৎসাহ ছিল?
তা ঠিক নয়। লেখার পর দেখতাম আমার নাটক নিয়ে যাঁরা পরিচালনা করতেন, গল্পটা আমি যেভাবে লিখছি, সেভাবে বানাতে পারছেন না। স্বাভাবিক, এক একজন মানুষ এক একভাবে দেখবে, বানাবে। তখন নিজেই নির্মাণে নেমে গেলাম।

হলিউড-বলিউডে ‘#মি টু’ আন্দোলনে কেঁপে উঠল। আমরা নীরব থাকলাম। তাহলে আমাদের এখানে পরিবেশ খুবই ভালো?
হলিউড ছাড়া, ‘#মি টু’ কোথাও সফল হয়নি। বলিউডের যে নারীরা মুখ খুলেছেন, তাঁদের অবমাননাকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে সবাই চুপ। মিডিয়ায় কাজ করা যাদের পেশা, সহকর্মীদের নিয়ে তারা যদি কিছু বলে, কাজের ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাবে। অনেকের জীবিকা এটা। তাদের সংসার চলে কাজের টাকায়, ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে, ঘরের বাজার হয়, বাড়িভাড়া হয়। আজ আপনি একজনের কাছে এসব জিজ্ঞেস করে প্রকাশ করবেন। কাল কিন্তু তার পাশে দাঁড়াবেন না। যদি আপনার মতো ১০ জন এসে কারও পাশে দাঁড়াত, তাহলে হয়তো অনেকেই অনেক কিছু বলতেন। ঠিক এ কারণেই আন্দোলন তৈরি হলো, থেমেও গেল।

পাশে কোনো পুরুষ না দাঁড়ানো একমাত্র কারণ?
আমরা মেয়েরাই একজন মেয়েকে সাপোর্ট করছি না। হাসিঠাট্টা করছি। একটা মেয়ে কারও সম্পর্কে অভিযোগ তুললে অভিযুক্তর কাছে গিয়েই মেয়েটাকে নিয়ে ঠাট্টা করছি। তখন অভিযোগকারীকে ছোট হতে হয়। সে তখন কোথায় যাবে। আবার ‘#মি টু’র চক্করে পড়ে অনেকে অযথা হেনস্তার শিকার হয়। আগে বুঝতে হবে জিনিসটা কী! ভুল মানুষকে অপরাধী বানানোর একটা ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যায়। কারণ আমাদের এখানে স্কুলিং নেই। বুদ্ধি-বিবেক-স্মার্টনেস নেই। চিন্তার জায়গাটা সংকুচিত। সব জায়গায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে, অভিনয়ের ক্ষেত্রে নেই। ফলে আমাদের এখানে ‘#মি টু’ আন্দোলন ঝুঁকিপূর্ণ। কারও কথা, স্পর্শ, চাহনির মধ্য দিয়ে অবমাননাকর কিছু ঘটলে, সেটা বুঝতে হলে যথেষ্ট বিচক্ষণ হতে হয়।

নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার
নাজনীন হাসান চুমকী। ছবি: খালেদ সরকার


যারা এ ধরনের ঘটনার শিকার, তাদের কী করা উচিত?
স্মার্টলি ফেস করতে হবে। কেউ এ রকম আচরণ করলে তার সঙ্গে চিৎকার করার দরকার নেই। মানুষ নিজের দোষটা শুনতে পছন্দ করে না। সুতরাং হাসিমুখে বিনয়ের সঙ্গে প্রথমে বোঝাতে হবে যে, কোনো নারীর সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করা উচিত নয়। আমার মনে হয় এটুকুই যথেষ্ট। যারা এ রকম করে, তাদের নিজেদেরও তো একটা সম্মান আছে। মানুষের মধ্যে পশুপ্রবৃত্তি আছে। সেটা সে যদি দমন করতে না পারে, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে, আপনার এই আচরণ সব জায়গায় প্রযোজ্য নয়। মানুষের ভেতরে অনেক ধরনের রিপু থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর এটা শুধু পুরুষ কেন, মেয়েদের মধ্যেও থাকতে পারে। তাকেও কারও না কারও থামাতে হবে। হয় মা-বাবা, নয় স্বামী। যদি বুদ্ধিমতী হয়, তাহলে পরামর্শ মেনে নেবে। তাতেও যদি কাজ না হয়, আইন–আদালত আছে। সামাজিক মিডিয়ায় সবকিছু শেয়ার করা ঠিক না। খোলা খাতা হওয়া উচিত না। ব্যক্তিগত একটা জায়গা রাখা উচিত।

আর কেউ যদি ‘#মি টু’র চক্করে গা ভাসাতে চায়?
কিচ্ছু করার নেই। লাভও নেই। এ নিয়ে মারপিট করার দরকার নেই। নারী-পুরুষনির্বিশেষে যারা সহজলভ্য হয়ে যায়, তাদের প্রতি একসময় কারোরই আকর্ষণ থাকে না, শ্রদ্ধা থাকে না। কেউ যদি ‘খোলা খাতা’ হয়ে যায়, তাকে কেউ পছন্দ করে না। এ কারণেই মেয়েদের কাছে বাবারা, আর ছেলেদের কাছে মায়েরা সবচেয়ে বড় হিরো।