ক্যানসারজয়ী ফুয়াদের গল্প

‘আমি এখন সম্পূর্ণ ক্যানসারমুক্ত।’ এ বছর ২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রথম আলোকে বলেছেন ফুয়াদ আল মুক্তাদির, এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় সুরকার ও সংগীত পরিচালক। এর আগে গত বছর ১৪ জানুয়ারি ফুয়াদ বলেন, ‘চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করেছি। আমার শরীরে প্যাপিলারি কারসিনোমা ধরা পড়েছে। এটা থাইরয়েড ক্যানসার। তবে কোন পর্যায়ে আছে, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’
২৯ জানুয়ারি নিউইয়র্কে ফুয়াদের দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়। পরদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাঁর স্ত্রী মায়া লিখেছেন, ‘ফুয়াদের দেহে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি দ্রুত সেরে উঠছেন। সবাইকে ধন্যবাদ।’ আর সেদিন দুপুরে ফুয়াদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি ফিরে আসছি।’

ফুয়াদ দারুণভাবে ফিরে এসেছেন। তাঁর এই ফিরে আসাকে উদ্যাপন করছে বন্ধু, সহকর্মী আর ভক্তরা। সুস্থ হওয়ার পর তিনি দুবার বাংলাদেশে এসেছেন। প্রায় এক দশক পর ঢাকার মঞ্চে আবার দেখা গেছে তাঁকে। গত শনিবার রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার হল ২-এ অনুষ্ঠিত হয় ‘ফুয়াদ লাইভ ইন ঢাকা’। ফুয়াদকে স্বাগত জানিয়ে তাঁরই গান গেয়েছেন ডি-রকস্টার শুভ, তাশফি, লিংকন, এলিটা, রাফা, আলিফ, তাপস, জোহান, কনা, আনিকা, ফাইরুজ ও জেফার। স্কাই ট্র্যাকার আয়োজিত এই কনসার্টের রেডিও পার্টনার ছিল এবিসি রেডিও।
কনসার্টের আগের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর মুখোমুখি হন ফুয়াদ আল মুক্তাদির। রাজধানীর শ্যামলীর আদাবরে কিউআরএস মিউজিকে হবে মহড়া। ততক্ষণে শিল্পীদের অনেকেই চলে এসেছেন—এলিটা, রাফা, আলিফ, জোহান। তার আগে শুরু হলো আড্ডা।

শুরুতেই ক্যানসার প্রসঙ্গ। ফুয়াদ বললেন, ‘কোনো লক্ষণ ছিল না। থাইরয়েডের ক্যানসার ধীরে ধীরে প্রভাব ফেলে। লক্ষণগুলো সহজে ধরা পড়ে না। লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় অনেক দেরিতে। তত দিন ৮-১০ বছর চলে যায়। শরীরে ক্যানসার অনেকটা জাঁকিয়ে বসে। আমার দেহে একেবারেই হঠাৎ করে ক্যানসার ধরা পড়ে।’
ফুয়াদের দেহে দুই ধরনের ক্যানসার পাওয়া যায়। প্রথমটি থাইরয়েড ক্যানসার, দ্বিতীয়টিও থাইরয়েড ক্যানসারের সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে এই দুই ধরনের ক্যানসার গত ৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ২০ জনের হয়েছে। ফুয়াদের কেসটা সবার থেকে এতটাই আলাদা ছিল যে চিকিৎসকেরা তাতে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন।

দেহে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে, তা নিশ্চিত হওয়ার পর ফুয়াদের সেই দিনগুলো কেমন ছিল? বললেন, ‘আমাকে কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়। শারীরিক থেকে আমার মানসিক সংগ্রাম ছিল অনেক বেশি। তখন আমার মেয়ের বয়স মাত্র ২। ওর কী হবে। এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। কেউ যদি হঠাৎ মারা যান, সেটা একরকম। কিন্তু যিনি বুঝতে পারছেন, তিনি মারা যাচ্ছেন বা মারা যেতে পারেন, এটা চিন্তা করা অনেক কঠিন। সবাইকে কীভাবে রেখে যাবেন, আপনি চলে যাওয়ার পর কী হবে। আমার জন্য পুরোটাই ছিল মানসিক যুদ্ধ।’
ওই সময় পুরো পরিবার এসে ফুয়াদের পাশে দাঁড়ায়। দারুণ ভূমিকা রেখেছেন তাঁর স্ত্রী মায়া। ফুয়াদ বললেন, ‘মা আর ভাইয়ারা যেখানে থাকেন, আমার বাসা একটু দূরে, প্রায় চার ঘণ্টার পথ। খবর পেয়ে সবাই আমার বাসায় চলে আসেন। সবাই এসে ফোন নিয়ে বসে যান। বিভিন্ন ক্যানসার হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। কোথায় ভালো চিকিৎসক আছেন, কোথায় সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে।’
চিকিৎসকেরা খুবই খুশি। ফুয়াদ বললেন, ‘কারণ এটা তাঁদের জন্য একটা বড় সাফল্য।’ চিকিৎসকদের মতো এখনো ততটা খুশি হতে পারছেন না ফুয়াদ। জানালেন, তাঁকে চিকিৎসকদের সংস্পর্শে থাকতে হবে। শুরুতে ছয় মাস পরপর, এর পরে এক বছর পরপর চিকিৎসকদের কাছে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় কিছু পরীক্ষা করতে হবে।

ফুয়াদের পরিবার ৩৬ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছে। সেখানে আছেন তাঁর মা, দুই ভাই আর তাঁদের পরিবার। এর মধ্যেই বাংলাদেশে আসেন। বললেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিই, বাংলাদেশে এসে কাজ করব। মিউজিক করব। আমি একলা ঢাকায় আসি, সেটা পরিবারের কেউ চায়নি। সবার সঙ্গে যুদ্ধ করে এসেছি। কারণ, আমি পরিবারের ছোট ছেলে। আমার বড় দুই ভাই। ওদের সঙ্গে আমার বয়সের অনেক পার্থক্য। একজনের সঙ্গে ১০ বছর, আরেকজনের সঙ্গে ৮ বছর। ২৩ বছর পর্যন্ত তাঁদের ওপর খুবই নির্ভরশীল ছিলাম। আমাকে সবকিছু করে দিতে হতো। আমি যে কিছুই করতে পারতাম না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু পরিবারের সবাই আমাকে সেভাবেই মনে করত। আমি তা থেকে বের হতে চেয়েছি। আর এর জন্য নিউইয়র্ক ছেড়ে ৭ হাজার মাইল দূরে ঢাকায় এসে থেকেছি। সবার ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজে নিজে দাঁড়াতে চেয়েছি।’

বাংলাদেশে তখন প্রায় ১১ বছর থেকেছেন ফুয়াদ। বাংলাদেশ ছেড়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে কেন চলে গেলেন? ফুয়াদ বললেন, ‘পরিবারকে খুব মিস করছিলাম। আরও একটা বড় কারণ ছিল। চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে আমরা দুটি সন্তান হারিয়েছি। উল্টাপাল্টা চিকিৎসার কারণে আমার স্ত্রীর দুবার গর্ভপাত হয়। এখানে চিকিৎসকদের ওপর আর নির্ভর করতে পারছিলাম না।’ আরও বললেন, ‘একটা বাক্সের মধ্যে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। অনেক কাজ করছি, অনেক গান করছি, অনেক পরিকল্পনা করছি, অ্যালবাম করছি, গান হিট হচ্ছে, তারপর কী হচ্ছে? খুব কনফিউজড হয়ে গেলাম। আমার পরবর্তী পদক্ষেপ আসলে কী হবে। এসব নিয়ে তখন খুব ভাবছিলাম।’

যুক্তরাষ্ট্রে এখন ফুয়াদের গানের চর্চা কেমন হচ্ছে? বললেন, ‘ওখানে গানটা কম করছি। পারিবারিক ব্যবসা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। আমাদের পরিবার হেলথ কেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেখানে আছে হাসপাতাল, ইমার্জেন্সি সার্ভিস, আর্জেন্ট কেয়ার ক্লিনিক। এই সবই আমার ভাইয়ার ব্যবসা। সেখানে আমি অনেক কিছু দেখাশোনা করি। মিউজিকের যদি বড় কোনো প্রজেক্ট থাকে, তখন ছুটির দিনে তা নিয়ে কাজ করি।’
সবার প্রিয় সুরকার ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের বয়স ৩৯। এখন তিনি একেবারেই পারিবারিক একজন মানুষ। এই যেমন সোমবার থেকে শুক্রবার অফিসে যান, ফিরে এসে স্ত্রী আর মেয়েকে সময় দেন। ছুটির দিনে বাজার করেন, মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যান। নেটফ্লিক্সের শো দেখেন। মা আর ভাইয়াদের বাসায় যান।

এলআরবির আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ১৮ অক্টোবর। সেদিন তাঁকে স্মরণ করে একটি গান তৈরি হয়। গানটার শিরোনাম ‘তুমি ছিলে প্রেরণায়’। গেয়েছেন ডি-রক স্টার শুভ। গানের কথা লিখেছেন আসিফ ইকবাল আর সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন ফুয়াদ আল মুক্তাদির। সেদিন সন্ধ্যায় গানচিল মিউজিকের ইউটিউব চ্যানেলে লিরিক্যাল ভিডিও আকারে গানটি প্রকাশ করা হয়েছে। ফুয়াদ বললেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু ভাই খুব অভিমানী ছিলেন।’
সবশেষে আবার ক্যানসার প্রসঙ্গ। দেশে এখন ক্যানসারের রোগী বাড়ছে। তাঁদের জন্য ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের পরামর্শ হলো, ‘যদিও মেনে নেওয়া খুব কঠিন। তারপরও মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। মনটাকে শক্ত করে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। গোড়াতেই যদি ভেঙে পড়েন, তাহলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সত্যি কথা হলো, আমাদের যেতেই হবে, কেউ আগে যাব কেউ পরে।’