অর্ণব ও তাঁর বন্ধুরা

মারুফ, বুনো, সাদ, নজরুল, পান্থ কানাই ও অর্ণব। ছবি: খালেদ সরকার
মারুফ, বুনো, সাদ, নজরুল, পান্থ কানাই ও অর্ণব। ছবি: খালেদ সরকার

ছাদটা ঠিক ছোটখাটো একটা ফুটবল মাঠের মতো। এক কোনায় চিলেকোঠা। চিলেকোঠাটি যেন আবার পুরোদস্তুর বাদ্যযন্ত্রের জাদুঘর। কোন বাদ্যযন্ত্রটা নেই সেখানে! অনেক বাদ্যযন্ত্রের ভিড়ে একটা ছোট্ট সোনালি গিটার দেখে চিনতে ভুল হয় না। এটা নিশ্চয়ই শায়ান চৌধুরী অর্ণবের গিটার। হতেই হবে, আমরা যে দাঁড়িয়ে আছি অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের চিলেকোঠায়। এখানেই সৃষ্টি হয় অনেক বর্ণ, গন্ধ, স্বাদের বাহারি গান। গানের আঁতুড়ঘরে ততক্ষণে চলে এসেছেন ব্যান্ডের নজরুল, সাদ, মারুফ কামরুল হাসান ও বুনো। বুনোর বেলায় অবশ্য ‘চলে এসেছেন’ খাটে না, কেননা তাঁর গুলশানের বাড়ির ছাদেই গানের এ আঁতুড়ঘর কি না।
রইল বাকি কে? পান্থ কানাই ও স্বয়ং অর্ণব। এদিক-সেদিক দেখতে না দেখতেই সিঁড়ির গোড়ায় তাঁর হাসিমুখের উদয়। অর্ণব এসেই বলেন, ‘খাবার আছে?’ মুখের কথা মাটিতে পড়ার সুযোগ পেল না, টেবিলে খাবার হাজির। ব্যান্ডের প্রায় সবাই এসে অর্ণবের খাওয়ার দৃশ্য চাক্ষুষ করে গেলেন। সবার দৃষ্টি যেন বলে দিচ্ছে—ছেলেটা ঠিকমতো খাচ্ছে তো?
অর্ণবও তেমনটাই বলেন, ‘অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের সবাই মোটামুটি আমার চেয়ে বড়। ফলে সবাই আমাকে গাইড করে। একটা সময় গানের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম। কিন্তু গত এক বছরে এই দলটার সঙ্গে থাকার পর মনে হলো, এটা একটা দারুণ দল! বুনো আমার অনেক দিনের বন্ধু। সংগীতের অনেক শাখায় ওর ভালো দখল। আমি কী চাই, সেটা ও খুব ভালো বোঝে। পান্থ ভাইও শিল্পী হিসেবে দুর্দান্ত। ঢোল বাজিয়ে মুগ্ধ করেন নজরুল ভাই। দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য সাদ তো নিয়মিত বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের গান শোনে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। ওর কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখি প্রতিনিয়ত। আর এরা সবাই আমাকে ধাক্কা দেয় সামনে চলার জন্য। ফলে আমি জোর পাই। এই ধাক্কাগুলো খুব জরুরি।’
কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই যদি অর্ণবকে ধাক্কা দিয়ে বসে কেউ, কেমন হবে বিষয়টা? আর কেউ না হোক, কাজটা যদি অর্ণবের খুব কাছের বন্ধু বুনোই করেন? মনে রাখতে হবে, এখনো এক বসায় টানা ১৪ থেকে ১৫টা মিষ্টি গলাধঃকরণ করার হিম্মত রাখেন বুনো! এই তথ্য আমরা পেলাম পান্থ কানাইয়ের কাছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস ঘুরে এল ভারত থেকে। বাংলা নাটক ডটকম আয়োজিত সুফি গানের উৎসব সুফি সূত্রই ছিল ভারতযাত্রার উদ্দেশ্য। কলকাতার মোহরকুঞ্জে তিন দিনের ওই উৎসবে এসেছিলেন ইরান, পতুর্গাল, সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেনের গানের দল ও শিল্পীরা। ভারত থেকে অংশ নিয়েছিল কলকাতা, পাঞ্জাব, বিহার আর রাজস্থানের শিল্পীরা। কেবল গানই নয়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোরাঘুরিও হয়েছে বিস্তর।
‘চলতি পথে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম বিহারে।’ বুনোর মিষ্টি ভক্ষণের কাহিনি বলছিলেন পান্থ, ‘সেখানকার মিষ্টি বেশ প্রসিদ্ধ। মুখে দিলেই গলে যায়। বুনো নানা রকমের মিষ্টি পেয়ে একটানা ১৪-১৫টা খেয়ে ফেলল!’
পান্থ কানাইয়ের কথা কানেই তুললেন না বুনো! তবে স্বীকার করলেন, ভারত সফর দারুণ ছিল। সফরের প্রথম দিন রাতে মহাবোধি মন্দির দেখতে বুদ্ধ গয়ায় গিয়ে দেখেন কোত্থাও খাবার নেই। কী করা যায়! বুদ্ধি বের করলেন মারুফ কামরুল হাসান। বললেন সে কাহিনি, ‘হঠাৎ দেখি একটা বিয়ে বাড়ি। গিয়ে ভুলভাল হিন্দিতে বললাম, “হামলোগ অতিথি হ্যায়!” ব্যস, মিলে গেল খাবার।’
মারুফের এই গুণটার কথা বারবার বলছিলেন অর্ণব, ‘যেকোনো কিছুই খুব চমৎকারভাবে ম্যানেজ করে ফেলেন মারুফ ভাই! দলের সবাইকে এককাট্টা করার দারুণ গুণও আছে তাঁর।’ প্রশংসা শুনে ব্যান্ডের শব্দ প্রকৌশলী মারুফ কেবল ‘আরে না না!’ করে গেলেন। অন্য দিকে অনেক ‘না না’ করেও রেহাই পান না সাদ। তাঁকে নাকি দলের বাকিরা কেবল ‘ভাঙায়’! কীভাবে ভাঙায়? উত্তর সাদের কাছেই, ‘কোথাও গেলে দলের সবাই আমার পকেটের টাকা দিয়েই খেতে চায়। এর আগে দলের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার সময় মায়ের কাছ থেকে ১০০ ডলার নিতাম। সেটা চলে যেত বড় ভাইদের খাওয়াতে খাওয়াতেই। এবার কলকাতা যাওয়ার আগে নিয়ে গেলাম মাত্র ৫০ ডলার। কিন্তু তাতেও রক্ষা হলো না! বড় ভাইয়েরা সেটাও “ভাঙালেন”!’ বোঝাই যায়, এমন ভাঙানি বা ‘ত্যাগে’ই সাদের প্রকৃত সুখ!

অর্ণব ও তাঁর বন্ধুরা
অর্ণব ও তাঁর বন্ধুরা

ভারত সফর নিয়ে সুখী অর্ণব। বিশেষ করে মোহরকুঞ্জ থেকে পাটনায় যাওয়ার পর এক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে তো বিস্মিতই হলেন তাঁরা। অর্ণব বলছিলেন ভালো লাগার কথা, ‘আমি তো হিন্দি অত ভালো পারি না। তাই আধো আধো হিন্দিতে বললাম—আমি একটা ভোজপুরি গান করব। গাইলাম “আব মাতাল লুটা” গানটি। গানটা শুনে শ্রোতারা তুমুল উদ্বেলিত! লোক ধারার গান ছিল সেটি। গান শেষে মানুষের প্রশংসা ও হাততালি পেয়ে বুঝলাম—লোক গানে একটা জাদু আছে। একদম শিকড়ের গান তো, তাই মানুষের ভেতরটা স্পর্শ করে।’
কেবল এ অভিজ্ঞতাই নয়, সফরজুড়ে আছে আরও ভালো লাগার কথা। অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের মতে, বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের ওই মিলনমেলা ছিল এককথায় দুর্দান্ত। বিভিন্ন ঘরানা, সুর ও কথার শিল্পীদের সঙ্গে ওই কটা দিন যেন সুরের হাওয়ায় ভাসার মতো। একেক দেশের গানের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র বাজানো কিংবা একে অন্যকে জানার মঞ্চই যেন ছিল সেটা। অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের সঙ্গে বেশ খাতিরও হয়ে গেছে সুফি সূত্রে আসা শিল্পীদের। অর্ণবের কথায়, ‘একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। এখন সব জায়গায় আমাদের বন্ধু আছে। যে কোনো দরকারে আমরা ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। ওরাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে এমন জানাশোনা খুব দরকার।’
অর্ণবের কাছে জানতে চাই, আপনাদের নতুন অ্যালবাম কদ্দুর? ব্যান্ডটির একমাত্র অ্যালবাম অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডস লাইভ বেরিয়েছিল সেই ২০০৯ সালে। অর্ণব জানান, সাত থেকে আটটা গান তৈরিই আছে। অর্ণবের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুনো বললেন, ‘সাত-আট তৈরি থাকলেও আসলে ভালো গান আছে তিন-চারটার মতো। আমরা আস্তে-ধীরে এগোচ্ছি। একদম খুব ভালো না হলে গান প্রকাশ করতে চাই না আমরা।’ এবার অর্ণবও কেড়ে নিলেন বুনোর মুখের কথা, ‘হ্যাঁ, আমরা এ ক্ষেত্রে খুব খুঁতখুঁতে। তবে সামনের ঈদে ইচ্ছা আছে অ্যালবাম করার। আশা করি পারব। আর চমৎকার এই বন্ধুদের সঙ্গে গান করা, আড্ডা দেওয়া চলতে থাকবে। এর মাঝে নিশ্চয়ই ভালো গান বেরিয়ে আসবে।’