জয়নুল-পরম্পরা

চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকদের শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীরা
চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকদের শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীতে দর্শনার্থীরা

বিস্তীর্ণ আকাশে রঙের ছড়াছড়ি। নদীতে সারি সারি নৌকা বাঁধা বাঁশের সঙ্গে। এক পাশে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে একজন জেলে। নদী ও নদী তীরের মানুষের জীবন নিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কালি ও জলরঙে ছবিটি এঁকেছিলেন ১৯৬৩ সালে। শিল্পাচার্যের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজিত প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল বিখ্যাত চিত্রকর্মটি। ইনস্টিটিউটের ‘শিল্পী রশিদ চৌধুরী আর্ট গ্যালারিতে’ ২০ জানুয়ারি চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকদের শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজন করা হয় এই প্রদর্শনীর।
জয়নুলকে নিবেদিত এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক ও বর্তমান ৪৫ শিক্ষকের ৯০টির মতো শিল্পকর্ম। এ দেশের চারুশিক্ষার গোড়াপত্তন জয়নুলের হাতে। পলিমাটির এই দেশে যে বীজ তিনি বপন করেছেন, তা যে রীতিমতো বৃক্ষে পরিণত হয়েছে, প্রদর্শনীতে এসে বোঝা গেল সেটা। পাশাপাশি এই প্রদর্শনী এ দেশের জয়নুল-পরবর্তী শিল্পচর্চার একটা অধ্যায়কে যেন উন্মোচন করল দর্শকদের সামনে। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, অতিথি ছিলেন কলা অনুষদের ডিন মো. সেকান্দার চৌধুরী ও চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক শিল্পী নাসিমা আখতার। পাঁচ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী শেষ হয় ২৪ জানুয়ারি।
প্রদর্শনীর শুরুতেই ছিল ‘বাঙলার বিদ্রোহ-একাত্তর’ শিরোনামে কালি ও কলমে রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, সবিহ্ উল আলম, মিজানুর রহিম ও আনসার আলীর আঁকা ছয়টি চিত্রকর্ম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য ছবিগুলো এঁকেছিলেন তাঁরা। এভাবে একটা যুগ ও ঘটনাস্রোতের সামনে এসে পড়েন দর্শকেরা।
একাত্তরের মতোই এ দেশের প্রকৃতি, গণমানুষ বারবার বিষয় হয়ে এসেছে শিল্পীদের কাজে। পোড়া মাটির অমসৃণ অবয়বে গড়া সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের ভাস্কর্য ‘জয়নুল আবেদিনের মা’ যেন চিরকালীন মাতৃত্বের ভঙ্গি নিয়ে হাজির হয়। সিরামিক টাইলসে নাসিম বানু তুলে আনেন পালকি-বেহারার গল্প।
জয়নুল-পরবর্তী শিল্পীরা কেবল এ দেশে প্রকৃতি ও সংগ্রামকে শিল্পের বিষয় করেননি; বরং আঙ্গিক নিয়ে নীরিক্ষা এবং স্বতন্ত্র শিল্পভাষা নির্মাণের চেষ্টা দেখা যায় তাঁদের মধ্যে। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া শিল্পী রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, আবুল মনসুর, ফয়েজুল আজিম, চন্দ্র শেখর দে, হাসি চক্রবর্তী, অলক রায় ও ঢালী আল মামুনের শিল্পকর্মে সেই লক্ষণই স্পষ্ট।
কাগজে কালি ও তুলিতে আঁকা ঢালী আল মামুনের ড্রয়িংয়ের অনেকটা জুড়েই ধূসর শূন্যস্থান। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পড়ে থাকা ফুল আর শ্বাপদের নখরের মতো হাত-পা দেখে তমসায় আচ্ছন্ন বর্তমান সময়ের কথাই মনে পড়ে দর্শকের। স্বতন্ত্র শিল্পভাষা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন নাজলী লায়লা মনসুরও। নারী তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে। নারীর স্বপ্নযাত্রার কাছে হার মানে সব বিরুদ্ধতা। অলক রায়ের ‘অর্গানিক অবয়ব’ এ দেশের ভাস্কর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁরই উপস্থাপন ‘লিভ টুগেদার উইথ নেচার’ নামের কাজটি।
পরবর্তী প্রজন্মের আলপ্তগীন তুষার, জাহেদ আলী চৌধুরী, শায়লা শারমিন, সুব্রত দাশ কিংবা জিহান করিমের মতো শিল্পীরাও নিজেদের ভাষাভঙ্গির সন্ধান করছেন। চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেন দর্শকের। প্রদর্শনী ছাড়াও জয়নুলের জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে স্লাইড শো এবং প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্পী ফয়েজুল আজিম। এতে আলোচক ছিলেন শিল্প–সমালোচক আবুল মনসুর। সভাপতিত্ব করেন শিল্পী জসিম উদ্দিন।