লায়লার স্বপ্ন

লায়লা
লায়লা

ঠিক সকাল ১০টা। কথার একটুও হেরফের হলো না। প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে হাজির লায়লা। সঙ্গে ইয়া বড় ব্যাগ। আড্ডা শেষে সোজা পাবনার বনপাড়ার প্রিয় মহিষভাঙা গ্রামে যাবেন। লায়লার ব্যাখ্যা, ‘আমার গ্রাম, এলাকাবাসী আমার জীবনের অংশ। তাঁদের ভালোবাসায় আমি সিক্ত, অভিভূত। আমার এলাকাবাসী প্রতিযোগিতা চলাকালীন আমার জন্য পথেঘাটে, মাঠে দাঁড়িয়ে এসএমএস ভিক্ষা করেছেন। তাঁদের ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।’

মহিষভাঙার মঞ্চ থেকে আজ পুরো বাংলাদেশের মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন লায়লা। তাঁর বাবা বাউলশিল্পী। এই বাউলকন্যা প্রথম হয়েছেন এবারের ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায়।

‘আমার বাবার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পেরেছি। আমার গ্রামের, এলাকাবাসীর কষ্টের মূল্য আমি দিয়েছি। এই অনুভূতির কথা বলা মুশকিল।’ প্রথম হওয়ার অনুভূতির কথা বলছিলেন লায়লা।

গানের ভুবনে পথচলা শুরু হলো কীভাবে?

সে এক লম্বা গল্প।

বাবা শফিকুল মৃধা গানপাগল মানুষ। হাঁড়িতে চাল নেই, সংসার ঠিকমতো চলে না। বাড়ির সঙ্গে খানকা শরিফ। প্রতিদিনই বাউল গানের আসর বসে। ১১ বছরের লায়লা চুপি চুপি বাবার গান শোনে। গান গেঁথে যায় মনে। কিন্তু বাবাকে ভয়, দরাজ গলায় হয় না গান গাওয়া। একদিন রাতে বাবা বাড়িতে নেই। সেই সুযোগে বড় বোনের ঘরে বসে ‘দিনে দিনে দিন ফুরাল...’ লালনের এই গান আনমনে গেয়ে চলেছেন লায়লা। বাবাও ওই সময় বাড়িতে হাজির। মেয়ের গান শুনে থমকে যান বাবা। গাওয়া শেষ হলে ঘরে ঢুকলেন বাবা। তাঁকে দেখে চমকে যান লায়লা। বাকিটুকু লায়লার মুখ থেকেই শুনি, ‘বাবাকে দেখে আমি তো ভয়ে অস্থির। কিন্তু বাবা নিজ থেকেই বললেন, “দোতারাটা নিয়ে আয়। আমি বাজাব, তুই গাইবি।” দোতারার সঙ্গে গান ধরলাম। যন্ত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে পারলাম না। বাবা রাগ করে বললেন, “তোর দিয়ে কিছু হবে না।” বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন তিনি।’

কিন্তু গানপাগল মানুষটি মেয়ের জন্য সারা রাত ঘুমোতে পারলেন না। শুরু করলেন মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা। পরের দিন থেকে বাবার হাত ধরে শুরু হলো লায়লার সংগীতচর্চা।

আস্তে আস্তে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লালন ও বিভিন্ন বাউলগান গেয়ে লায়লা পৌঁছে গেলেন এলাকার মানুষের অন্তরে। এরপর পেয়ে গেলেন ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ প্রতিযোগিতার সন্ধান।

গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, নেই টেলিভিশন। পত্রিকার কোনো খবরও পৌঁছায় না সেখানে। তাই গানের কোনো প্রতিযোগিতার খবরই পৌঁছায় না লায়লার কানে। একদিন এক প্রতিবেশির মাধ্যমে জানলেন ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ প্রতিযোগিতায় শিল্পী বাছাইয়ের জন্য আবেদন চলছে। পরের ঘটনা লায়লার জন্য ইতিহাস!

অনেকেই ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ হয়ে আবার হারিয়েও গেছেন। সেই পথে হারাতে চান না লায়লা। বললেন, ‘আমি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, এই প্রতিযোগিতা দিয়েই আমার গান শেখা শুরু। অনেক দূর যেতে হবে।’

অনেক দূরে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্যই ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে সংগীত বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। লায়লা বললেন, ‘ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়তে চাই। একজন ভালো মানুষ ছাড়া পবিত্র এই সংগীত হূদয়ে বসবাস করতে পারে না। ছোটবেলা থেকে গানই প্রাণ, গানই প্রেম, গানই ভালোবাসা।’

প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার সুবাদে ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন লায়লা। স্বপ্ন দেখেন এই টাকা দিয়ে একটা বাউল একাডেমি গড়ার। বললেন, ‘আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যারের অনুপ্রেরণা, আদেশে এই স্বপ্ন দেখি। বনপাড়া উপজেলার ভূমি অফিস থেকে উপজেলা সদরে একখণ্ড খাসজমি দিতে চেয়েছে। জমির ওপর একটা একাডেমি করতে চাই, যেখান থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গান শিখে সারা দেশে আলো ছড়াবে।’