শুভ-তিশাদের 'অস্তিত্ব' নিয়ে

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

আইটেম-রোমান্টিক মিলিয়ে কয়েকটি গান, দুটো মারপিট আর একটুখানি কৌতুক। একটি সিনেমাকে পাশ মার্ক দিতে আর কী চাই? দর্শক হয়তো এইটুকুতেই খুশি হয়ে বলবেন, ‘পয়সা উশুল।’ অনন্য মামুন পরিচালিত ‘অস্তিত্ব’ ছবিটিও সেভাবে দর্শকের পরীক্ষায় পাস করে যাবে। কিন্তু প্রতিযোগিতার দৌড়, লগ্নি তুলে আনা, পরের ছবিটার জন্য প্রেরণা কুড়োতে মামুনকে নম্বর টানতে হবে। পেতে হবে এ, এ প্লাস কিংবা গোল্ডেন এ প্লাস। চলুন সবাই মিলে মামুনকে একটু এগিয়ে রাখি। ভাগাভাগি করি তাঁর ছবিটি দেখার অভিজ্ঞতা।

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

গল্পটি ইতিবাচক
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, সম্পদ দখল, চোরাচালান, খুন, ধর্ষণ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশের দর্শক। অতিপ্রেম, যৌনতার সুড়সুড়ি, অতি অভিনয়ও অনেক দেখা হলো। সিনেমায় এখন একটু ভালো গল্প দেখতে চায় দর্শক। পরিচালক বেশ ঝুঁকি নিয়ে ভিন্ন একটি গল্প দেখিয়েছেন। বহুদিন পর একটি ব্যতিক্রম গল্পে নির্মিত হলো বাংলা সিনেমা। প্রচলিত রীতিতে এই ছবি লোকে সাধারণত ‘খায়’ না। নায়িকার ঠোঁটে সংলাপ নেই, নেই অকারণ রোমাঞ্চ জাগানো দৃশ্য। আড়াই ঘণ্টায় নায়িকা উচ্চারণ করেছেন হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি শব্দ। তবু পর্দায় তাঁর উপস্থিতি বিনোদন জুগিয়েছে দর্শকদের। প্রকৃত সামাজিক ছবিও বলা যায় একে। পরিবার নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখার মতো। গল্পটিও দারুণ ইতিবাচক। গুলি কিংবা বোমার বদলে খলনায়ক এগিয়ে দিয়েছেন গোলাপ। নায়িকাকে বেঁধে ধর্ষণের বদলে তুলে দিয়েছেন চিপস-জুস! এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে। এভাবে ইতিবাচকতা হয়তো একসময় পর্দা থেকে ছড়িয়ে যাবে বাস্তব সমাজে।

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

ফুলস্লিভ জামা পরে আইটেম গান
‘অস্তিত্ব’ ছবির পাঁচটি গানই সুন্দর। ‘তোর নামে লিখেছি হৃদয়’ গানের সেট অসাধারণ, ‘আয় না বল না’-এর দৃশ্যায়ন অনন্য। তার থেকেও অভাবনীয় ছবির আইটেম গানটি, যেখানে ফুলস্লিভ জামা গায়ে নেচেছেন নায়িকা তিশা। মূল গানগুলোর বাইরে আশাবাদ ছড়িয়েছে শিশুদের কণ্ঠে বেশ কয়েকবার ‘আমরা করব জয়’। অপ্রয়োজনীয় লেগেছে জোভানদের গানটি। জড়তা নিয়ে হাত-পা ছুড়লে দেখতে একটু বিরক্ত লাগাটাই স্বাভাবিক।

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

নেই সুড়সুড়ি
যৌন সুড়সুড়ির ব্যর্থ ও অযৌক্তিক দৃশ্যায়নের ঝুঁকি পরিচালক নেননি। সিনেমা বানালে এ ধরনের দৃশ্য না রাখাটাই যেন একধরণের অসভ্যতা হয়ে উঠেছিল। গল্পের জন্য প্রয়োজন হয়নি বলে যে তিনি অমন দৃশ্য রাখেননি, সে রকম মনে হয়নি। বরং গল্পের জন্য দুটি রোমান্টিক গানও অপ্রয়োজনীয় ছিল। তারপরেও বিনোদনের সংযুক্তি হিসেবে সেগুলো দেখতে খারাপ লাগেনি। সমাজে বিশেষ শিশুদের যে কখনো কখনো যৌন নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়, সেসবও নেই ছবিতে। নির্মাতা যেন চেয়েছেন একেবারেই ইতিবাচক একটি ছবি বানাতে। তাই নেতিবাচকতা ও অসুন্দরের ঠাঁই নেই তাঁর ছবিতে।

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

শুরুর ক্লান্তি
ছবির পোস্টার দেখে মনে হতে পারে ‘অস্তিত্ব’ এক ভরপুর প্রেমের ছবি। অথচ প্রেমের ‘প’-ও নেই ছবিতে। দর্শক হতাশ হতে পারেন, গালমন্দ করতে পারেন। কী দেখানোর কথা বলে নিয়ে গেল হলে? দেখালো বিশেষ-শিশুদের এক বিশেষ স্কুলের কাহিনি! বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণ-তরুণীর রোমান্টিক সম্পর্কের হাত ধরে মূল গল্পে ঢোকাটাও দর্শকের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে।

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

দর্শক জরিপ
গত শুক্রবারের প্রথম প্রদর্শনীর পর বলাকা সিনেমা ও যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাসের কয়েকজন দর্শকের সঙ্গে কথা হয় ছবিটি নিয়ে। একজন বলেন, গানগুলোতে তিশাকে ভালো লেগেছে। তবে তাঁকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারেননি পরিচালক। ওই দর্শকের প্রত্যাশা ছিল নায়িকাকে আরও একটু ‘নায়িকা’ হিসেবে দেখার। শুভকে নিয়ে তাঁর কোনো অতৃপ্তি নেই। নিয়মিত বলিউড ও হলিউডের ছবি দেখা আরেক দর্শক জানালেন, ছবির সিনেমাটোগ্রাফ খারাপ না। প্লটটা দারুণ। বেশ কিছু জায়গায় লিঙ্ক করতে বেগ পেতে হয়েছে পরিচালককে। কিছু জায়গায় ব্যর্থও হয়েছেন।
দর্শকসারি থেকে বসে আমারও মনে খটকা তৈরি করেছে কয়েকটি বিষয়। সিলেট থেকে তিন ঘন্টায় এতগুলো বিশেষ শিশু কীভাবে ঢাকার হাসপাতালে পৌঁছাল? একজন দুষ্কৃতকারী নিজেকে বাঘের বাচ্চা দাবি করতে পারে। বিশেষ শিশুদের একজন প্রশিক্ষক কি তাঁর কাছে জানতে চাইবেন যে তাঁর মা জঙ্গলে গিয়েছিলেন, নাকি বাঘটাই বাসায় এসেছিল? নায়ক-ভিলেন সংলাপে নিরীহ এ কৌতুকটির ব্যবহার নিয়ে আরেকটু ভেবে দেখা যেত বোধ করি। কানে হেডফোন, কাঁধে কলার কাঁদি রেখে কলা খাওয়া চরিত্রটি কোত্থেকে উদয় হলো, বুঝিনি।

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

আরিফিন শুভ
ছবিতে পর্দায় প্রথমবার শুভ উদয় হতেই হর্ষধ্বনি করে ওঠে তরুণ দর্শকেরা। এই উচ্ছাস হয়তো বাংলার দাপুটে নায়কদের জন্য শঙ্কার শঙ্খধ্বনি। ইতিমধ্যে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করে ইতিমধ্যেই আলোচনায় চলে এসেছেন শুভ। পুরস্কার, সম্মাননা, করতালি, হর্ষধ্বনি—সবকিছুর পেছনেই রয়েছে তাঁর অভিনয়। সেটাকে ‘লাইক’ দিতেই হবে। শুভর সামনে হাজার মাইলের রানওয়ে। তাঁকে সেখানে দৌড়ে এগিয়ে যেতেও হবে, আবার উজ্জ্বলতা নিয়ে দৃশ্যমানও থাকতে হবে। ‘অস্তিত্ব’ দেখে মনে হবে, শুভ দৌড় শুরু করেছেন তুমুল উদ্যোমে। তাঁর জন্য শুভকামনা।

অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য
অস্তিত্ব ছবির একটি দৃশ্য

শেষ হাহাকার
তরুণ, হ্যান্ডসাম প্রশিক্ষক অসুস্থ হয়ে আসন গেড়েছেন হুইলচেয়ারে। মৃত্যুর জন্য শুরু হয়েছে তাঁর অপেক্ষা। ঠিক সেই সময়ে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরে সামনে এল তাঁর প্রিয় ছাত্রীটি। শিক্ষকের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল এক ফোঁটা হাহাকার। পরিচালক বিশদ ব্যাখ্যায় যাননি। ফলে হাহাকারটি শিল্পসৌন্দর্যে উত্তীর্ণ হয়েছে। সব মিলিয়ে ছবিটি কেমন হলো, দর্শক তা দেখে নম্বর দিক নিজেই।