সেই দুর্বিষহ স্মৃতির বয়ান

আণবিক বোমা হামলার অভিজ্ঞতার কথা বলছেন নাগাসাকির হিবাকুশা (বোমা হামলার িশকার) মিনোরু মোরিউচি l প্রথম আলো
আণবিক বোমা হামলার অভিজ্ঞতার কথা বলছেন নাগাসাকির হিবাকুশা (বোমা হামলার িশকার) মিনোরু মোরিউচি l প্রথম আলো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনো থামেনি। যুদ্ধের কারণে অভাব-অনটন বেড়ে যাওয়ায় খেলার সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। তাই যেসব খেলাধুলায় বাড়তি কিছুর প্রয়োজন নেই, তাতেই ঝুঁকেছিল কিশোর-কিশোরীরা। গ্রীষ্মে চারপাশটা যখন ঘুরঘুরে পোকা বা উচ্চিংড়ার ডাকে মাতোয়ারা থাকে, সেই সময় পোকা ধরতে বের হতো কিশোর মিনোরু মোরিউচি। পোকা ধরে বাক্সবন্দী করে খেলাই ছিল তার প্রধান আনন্দ। আট বছরের কিশোর মিনোরুর পরিষ্কার মনে আছে সেই সকালটার কথা। ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে ঘুরঘুরে পোকার ডাক শোনে পোকা ধরার জন্য বালক মিনোরু তড়তড় করে উঠে পড়েছিল বড় এক পার্সিমন গাছে। সেখান থেকেই সে দেখেছিল আলোর ঝলকানি। আলোর সেই ঝলকানির কারণ মিনোরুর জানা ছিল না। উজ্জ্বল সেই আলোকরশ্মি কতটা ক্ষতিকর, তা বোঝার আগেই সে তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসেছিল।

আণবিক বোমা যেখানটায় বিস্ফোরিত হয়েছিল, মিনোরুদের বাড়ি ছিল তার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। তাই প্রথম দিনের তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব খুব বেশি ক্ষতিকর ছিল না। তবে নাগাসাকির নগর কেন্দ্রের কাছে বসবাসরত আত্মীয়রা কেমন আছেন, তা খুঁজে দেখতে দুদিন পর মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন সেখানটায়। জায়গাটি ছিল বোমা হামলার কেন্দ্রস্থল থেকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে। সেখানটায় যে বীভৎসতা মা-ছেলেকে দেখতে হয়েছিল, এর জন্য তাঁরা তৈরি ছিলেন না। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে বাড়িঘর আর স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ, পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ। ধ্বংসাবশেষ আর মৃতদেহের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে নিজেদের অজান্তেই অনেক বেশি মাত্রার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে আসতে হয় মিনোরু আর তাঁর মাকে।

তাঁদের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ছয়জন বিধ্বস্ত বাড়ি ছেড়ে মিনোরুদের বাড়িতে চলে এসেছিলেন। সেখানে ছয়জনের সবাই একে একে তেজস্ক্রিয়তার দূষণে প্রাণ হারান। এসব মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী মিনোরুও একসময় তাঁর দেহে তেজস্ক্রিয়তার নানা প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেন। বাড়ির অন্যরাও বুঝে গেছেন, আট বছরের বালক আর আগের জীবনে ফিরতে পারবে না। তবে ব্যাধির সঙ্গে লড়াইটা যে সারা জীবনের যুদ্ধ হয়ে যাবে, সেটা মিনোরুর জানা ছিল না।

সেদিনের সেই বালক এখন নাগাসাকির আণবিক বোমা হামলার ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সমিতির সহসভাপতি মিনোরু মোরিউচি। ৮০ বছরে এসেও তিনি মানুষের কাছে বলে যাচ্ছেন তাঁর সেই দুর্বিষহ স্মৃতি। উদ্দেশ্য একটাই, ভয়ংকর সেই স্মৃতিকে জাগিয়ে রেখে মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তোলা।

নাগাসাকি আণবিক বোমা জাদুঘরের একটি কক্ষে সম্প্রতি কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন মিনোরু মোরিউচি। তিনি মনে করেন, আরেকটি যুদ্ধ শুরু হলে সমগ্র বিশ্বের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই জীবনসায়াহ্নে এসেও কাজটা করে যাচ্ছেন। তাঁর মনে এখন কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভ কিংবা ঘৃণা নেই। আণবিক বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন যুক্তরাষ্ট্রের সেদিনের বর্বর আচরণ ভুলতে পারেন না।

গত মাসে জাতিসংঘের ১২২টি সদস্য দেশের স্বাক্ষরিত পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি হতে দেখা তাঁর জন্য আনন্দের এক অভিজ্ঞতা। তবে একই সঙ্গে নিজের দেশ জাপানের সেই চুক্তির বাইরে থাকাটা তাঁকে মর্মাহত করছে।

নাগাসাকির বোমা হামলার স্মৃতি ধরে রাখায় মিনোরু মোরিউচির মতো হিবাকুশাদের (বোমা হামলার শিকার) পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে নাগাসাকি আণবিক বোমা জাদুঘর। জাদুঘরের স্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বিধ্বস্ত উরাকামি গির্জার হুবহু একটি নকল স্থাপনা। আরেকটু সামনে এগোলেই চোখে পড়ে কাচের ফ্রেমে রাখা নকল ফ্যাট ম্যান, নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের সেই আণবিক বোমা। জাদুঘর জুড়ে রাখা আছে ভয়াবহতার আরও অনেক নমুনা, যার সবকিছুই আমাদের মনে করিয়ে দেয় কতটা নির্মম আর নৃশংস ছিল সেই বোমা হামলা। সেই সঙ্গে মনে হয়, সে রকম ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি থেকে জগৎ–সংসারকে বাঁচিয়ে রাখা কতটা জরুরি।