পাকিস্তানের কী যায়-আসে?

পাকিস্তানে মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানে মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স গত ডিসেম্বরে আচমকা আফগানিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। তখন তিনি পাকিস্তানকে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে ভর্ৎসনা করেন। পাকিস্তানের কঠোর সমালোচনা করেন। এর কয়েক দিন পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানকে নিরাপত্তা সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। বলেন, আফগানিস্তানের তালেবান যোদ্ধাদের পাকিস্তানের মাটিতে নিরাপদে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এরপরই দুই দেশের টানাপোড়েনের সম্পর্ক যেন নতুন করে তেতে উঠল। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলে বলেছে, এটি ‘স্বেচ্ছাচারমূলক ও একতরফা সিদ্ধান্ত’।

এখন প্রশ্ন হলো, এই সহায়তা বন্ধে পাকিস্তানের কী যায়-আসে?

নিজেদের মাটিতে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানা হয়ে ওঠা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে প্রায় সব ধরনের নিরাপত্তা সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। যদিও ঠিক কী পরিমাণ বরাদ্দ কমানো হবে, তা এখনো বলেনি ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সহায়তা যতটুকু বন্ধ হতে পারে বলে মনে হচ্ছে, এর প্রভাব ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে।

এর মধ্যে ফরেন মিলিটারি ফাইন্যান্সিংয়ের (এফএমএফ) অধীনে পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ খাতে ২২৫ মিলিয়ন ডলার স্থগিত হতে পারে; আর কোয়ালিশন সাপোর্ট ফান্ডের (সিএসএফ) অধীনে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় পাকিস্তানকে দেওয়া ৭০০ মিলিয়ন ডলার।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই নেতিবাচক পদক্ষেপের প্রভাব যতটা মনে করা হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি হতে পারে। বিশেষ করে মার্কিন সিনেট এরই মধ্যে বলেছে, প্রতিরক্ষা বিভাগ বিভিন্ন খাতে দেওয়া নিরাপত্তা সহায়তাও বন্ধ করে দিতে পারে।

মার্কিন প্রশাসনের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে অন্তত অল্প সময়ের জন্য হলেও চাপে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

‘মিলিটারি, স্টেট অ্যান্ড সোসাইটি ইন পাকিস্তান’ বইয়ের লেখক এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাসান রাসকারি রিজভি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে বর্তমানে পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জামের উন্নয়ন ও লোকবল বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা থাকলে তা থেমে যাবে।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এ সংকট লম্বা সময়ের জন্য হতে পারে। কেননা, সামরিক সরঞ্জামকে সচল রাখতে পাকিস্তান চীন বা অন্য কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে পুরোপুরি এ অর্থ সহায়তা পাবে না। তাই পাকিস্তান সরকার ট্রাম্পের বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছে।

গত সোমবার টুইটার বার্তায় ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতো গত ১৫ বছরে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার পাকিস্তানকে সহায়তা দিয়েছে। বিনিময়ে তারা ‘মিথ্যা ও প্রতারণা’ ছাড়া কিছুই পায়নি। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, শান্তি অর্জনে কাজ করতে হলে দরকার ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের পাশাপাশি পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন এবং আস্থা। খামখেয়ালি সময়সীমা, একতরফা ঘোষণা ও লক্ষ্যস্থল পরিবর্তন অভিন্ন হুমকি মোকাবিলায় নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে ইসলামাবাদ বলেছে, গত ১৫ বছরে প্রধানত নিজস্ব সম্পদ দিয়েই সে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে। এই সময়ে এই খাতে তারা ব্যয় করেছে ১২ হাজার কোটি ডলার।

বিবিসির পক্ষ থেকে পাঠানো এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, পাকিস্তান কখনো টাকার জন্য লড়াই করেনি, শান্তির জন্য লড়েছে।

পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে চাপে রাখতে মূলত এ পদক্ষেপ বলে মনে করেন অধ্যাপক আশকারি। তিনি বলেন, যদিও এটা হয়তো চোখে দেখা যাবে না; তবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকায় কিছুটা পরিবর্তন অবশ্যই হবে। অন্তত তারা হাক্কানি নেটওয়ার্ককে কিছু সময়ের জন্য চুপচাপ থাকতে বলবে।

সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ আফগানিস্তানে ১৬ বছর ধরে জারি রয়েছে মার্কিন আগ্রাসন। আফগান যুদ্ধে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ ও সেনা পাঠানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তান তাদের অপরিহার্য প্রবেশপথ। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে একটা বড় পরিমাণের নিরাপত্তা ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান সেই পথ কি বন্ধ করে দেবে? এর আগে অবশ্য এমনটা হয়েছিল। ২০১১ ও ২০১২ সালে কয়েক মাসের জন্য পাকিস্তান ওই রুটটি অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। তখন পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। বল ছিল পাকিস্তানের কোর্টে। সে সময় পাকিস্তানকে না জানিয়ে দেশটিতে ইউএস নেভি সিলস অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল। এমনকি মার্কিন যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া বোমা হামলায় ২০ জনেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

কিন্তু অধ্যাপক আসকারি বলেন, এখন পাকিস্তান সেই পথে এগোবে না। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি নমনীয় ছিল। কারণ, তখন ভুলটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। তাই পাকিস্তানের ক্ষোভ ছিল যৌক্তিক। কিন্তু এখন পরিস্থিতি উল্টো। তাই পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

পাকিস্তান হয়তো আফগানিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ ও সেনা পাঠানোর ওই রুটে কিছুটা বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা বিলম্ব ঘটাতে পারে; কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চাইবে না। কারণ, এর ফলে হয়তো দুই দেশের সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে পারে।

এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বেসামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আর সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ‘শর্ত ও খাতভিত্তিক পন্থা’ অবলম্বন করতে পারে। এর আওতায় নির্দিষ্ট খাতে এবং পরিমাপ করা যাবে, সেখানেই তহবিল ছাড় করা হবে।

অন্যদিকে, এর বিপরীত হলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হওয়া মানে হলো ন্যাটোর বাইরের বড় জোট থেকে পাকিস্তানকে বাদ দিতে পারে। এমনকি পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক বলেও আখ্যায়িত করতে পারে। অথবা ওই অঞ্চলে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বেশ জোট বাঁধতে পারে। তবে মনে হয় না কোনো পক্ষই এ ধরনের পদক্ষেপ চায়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা চায় না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিন ফেয়ার বলেন, বিশ্বে দ্রুতগতিতে যেসব দেশে পরমাণু কর্মসূচি প্রকল্প গড়ে উঠছে, এর মধ্যে পাকিস্তান একটি। বলা হয়, বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী পাকিস্তানের মাটিতে শিকড় গেড়ে বসেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও বন্ধু রাষ্ট্ররা পাকিস্তানে কোনোভাবেই অস্থিতিশীলতা চাইবে না। কেননা, এ সুযোগে পাকিস্তানের পরমাণু প্রযুক্তি জঙ্গিদের হাতে চলে যেতে পারে।