নববধূর সতীত্ব পরীক্ষা!

দুই বছর আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ২২ বছরের অনিতা। (পরিচয় গোপনের স্বার্থে নাম পরিবর্তন হয়েছে)। কিন্তু তাঁর সতীত্ব আছে কি না, এর জন্য একটি পরীক্ষায় তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপরই থেকেই তাঁর কপালে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। এটা শুধু অনিতা নয়, নাম না-জানা আরও অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে। সমালোচনা ও প্রতিবাদের পরও এটি বন্ধ হচ্ছে না। নববধূর সতীত্ব পরীক্ষা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।

‘রামায়ণে’ সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল। এখনো অনেক সীতাকে সে রকমই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ই দিতে হচ্ছে। সীতাদের নাম বদলে কোথাও হয়েছে অনিতা। অতীতে অযোধ্যা বর্তমানে মহারাষ্ট্রের কঞ্জরবাট এলাকা। এই এলাকাটিতে আদিবাসীদের বাস। এখানকার সদ্যবিবাহিত নারীদের পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি বিয়ের দিন পর্যন্ত সতীত্ব। নবদম্পতির জন্য পাতা বিছানায় সাদা চাদরে রক্তের দাগ লাগলেই মিলবে সতীত্বের তকমা। সমাজ মেনে নেবে যে বিয়ের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে নববধূর কপালে জোটে নানান অপবাদ, বের করে দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়ি থেকে।

দিল্লির স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সোনিয়া নায়েক বলছিলেন, ‘এর অনেক কারণই আছে। যেভাবে নারীর সতীত্ব পরীক্ষা হচ্ছে, সেটা অবৈজ্ঞানিক। কারণ প্রথমবার শারীরিক সম্পর্কের সময়ে যে সেটা ঘটবেই, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অনেক সময়ে প্রথমবার স্বামী-স্ত্রীর প্রথম রাতের পরেও নারীর ক্ষেত্রে সেটা না-ও হতে পারে।’

কঞ্জরবাট এলাকায় প্রায় দুই লাখ মানুষের মধ্য অনিতার মতো অনেকেই আছেন। ‘সতীত্ব না হওয়ার অপরাধে’ অনিতার মতো অনেক নববধূকে বেইজ্জত হতে হয়। অনেক সময় পেটানোও হয়। আর সতীত্ব প্রমাণ না হলে স্বামী সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করার অধিকার পেয়ে যান। এই অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক ধারণার কারণে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন মারাঠি যুবক বিবেক তামাইচাকার।

নববিবাহিত দম্পতিকে হোটেলের কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাদা চাদর। নবদম্পতি বাইরে এলে ওই সাদা পরীক্ষা করে দেখা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নববিবাহিত দম্পতিকে হোটেলের কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাদা চাদর। নবদম্পতি বাইরে এলে ওই সাদা পরীক্ষা করে দেখা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বিবেক বলছিলেন, ‘আমি তখন ছোট। বছর ১২-১৩-এর মতো বোধ হয় হবে। একটা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখলাম নববধূকে অনেকে মিলে পেটাচ্ছে। বুঝতে পারিনি কেন এমনটা হচ্ছে। বড় হয়ে ওই দিনের পুরো বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। সদ্যবিবাহিত ওই নারী আসলে সতীত্বের পরীক্ষায় ফেল করেছেন।’

আর যাতে কোনো নববধূকে বিয়ের পরেই সতীত্ব পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে পিটুনি খেতে না হয়, সে জন্য সম্প্রতি বিবেক তার কয়েকজন বন্ধু মার খেয়েছেন।

এই প্রথা বন্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন বিবেক তামাইচাকার। ‘স্টপ দ্য ভি রিচুয়াল’ নামে একটা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপও হয়েছে। এর অর্ধেক সদস্যেই নারী। ‘ভি রিচুয়াল’ অর্থ ভার্জিনিটি রিচুয়াল বা সতীত্ব পরীক্ষা।

রাজ্যের পুনে শহরে একটা বিয়েবাড়িতে বিবেক আর তার কয়েকজন বন্ধু এ পরীক্ষা বন্ধের স্বপক্ষে প্রচার চালাতে গিয়েছিলেন। সেখানেই কঞ্জরবাট সমাজের লোকজন তাদের পেটান। পুলিশ সেখান থেকে ৪০ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে। ছোট আকারে প্রকাশিত এ সংবাদের সূত্র ধরেই খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, নারীর সতীত্ব পরীক্ষার মতো মধ্যযুগীয় বর্বর প্রথার খোঁজ মেলে।

কীভাবে হয় সতীত্ব পরীক্ষা?
মহারাষ্ট্রের কঞ্জরবাট এলাকায় বিয়ের রীতি রেওয়াজ শেষে নববিবাহিত দম্পতিকে একটা হোটেলের কক্ষে পাঠানো হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় সাদা চাদর। যদি হোটেলের ভাড়া দিতে নববিবাহিত দম্পতির পরিবার অক্ষম হয়, তবে তা পরিশোধ করে পঞ্চায়েত কমিটি। ঘরের বাইরে অপেক্ষায় থাকেন দুই পরিবারের স্বজনেরা। শারীরিক মিলনের পর নবদম্পতি বাইরে এলে ওই সাদা পরীক্ষা করে দেখা হয়। এই পরীক্ষার ওপরই নির্ভর করে ওই নারীর সতীত্ব আছে কি না।

অনেক সময় বরকে এ ব্যাপারে শিক্ষিত করে তোলার নামে মদ খাওয়ানো হয় আর দেখানো হয় পর্নো ছবিও।

মারাঠি যুবক বিবেক তামাইচাকার সতীত্বের পরীক্ষার অমানবিক উপায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। ছবি: বিবিসি
মারাঠি যুবক বিবেক তামাইচাকার সতীত্বের পরীক্ষার অমানবিক উপায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। ছবি: বিবিসি

সতীত্বের পরীক্ষায় ফেল করা অনিতা বলছিলেন, ‘বিয়ের আগেই হবু স্বামীর সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। তাই আমার স্বামীর একটা ভয় ছিল যে আমি হয়তো পরীক্ষায় পাস করতে পারব না। ভেবেছিলাম, আমার স্বামী পাশে দাঁড়াবে, কিন্তু সেই রাতে যা ঘটল, এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।’

ওই রাতের ‘পরীক্ষা’র পরে সবার সামনে পঞ্চায়েত বসিয়ে অনিতার স্বামীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অনিতা ‘পবিত্র’ না ‘অপবিত্র’।

অনিতা বলেন, ‘আমার স্বামী নির্দ্বিধায় আঙুল তুলে সাদা চাদরটা দেখিয়ে দিল। অথচ তার কথাতেই রাজি হয়ে আমি বিয়ের মাস ছয়েক আগে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছিলাম। আর ওই কঠিন সময়ে সে আমাকেই অপবিত্র বলে দিতে একবারও দ্বিধা করল না! পঞ্চায়েত আমাকেই ‘ফেক’ বলে দিল।’

পুলিশ আর স্থানীয় সামাজিক আন্দোলনের কয়েকজন নেতা-কর্মীদের মধ্যস্থতায় অনিতার সঙ্গে থাকতে রাজি হয়েছিলেন তার স্বামী।

তবে স্বামীর ঘর করাটা অনিতার কাছে দিনের পর দিন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিনই মারধর করত অনিতার স্বামী।

‘গর্ভবতী হওয়ার পরেও অবস্থা পাল্টায়নি। স্বামী আমাকে সব সময়ে জিজ্ঞাসা করত যে পেটের বাবুর বাবা কে! সে তো জানত কার সন্তান রয়েছে আমার গর্ভে! শুধু স্বামী নয়, পঞ্চায়েতের লোকেরাও ওসব বলত’, জানান অনিতা।

সন্তান প্রসবের দুই মাসের মধ্যে সদ্যোজাত সন্তানসহ অনিতাকে তাড়িয়ে দেন স্বামী। অনিতা এখন বাবা-মায়ের কাছে থাকেন।

আর যেহেতু পঞ্চায়েত অনিতাকে ‘অপবিত্র’ বলে রায় দিয়েছে, তাই দুই বোনের বিয়ে দিতেও সমস্যা হচ্ছে।

বিবেক তামাইচিকার বলেন, ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এ বছরের শেষে। কিন্তু আমি তো পঞ্চায়েতকে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছি যে আমার স্ত্রী কোনোমতেই ওই সতীত্বের পরীক্ষা দেবে না। কিন্তু শুধু আমি বা আমাদের গ্রুপের সদস্যরা বললে তো হবে না।’