প্রতিকূলতা জয় করা এক স্বপ্নবাজ

মার্কিন সিনেটর ট্যামি ডাকওয়ার্থ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
মার্কিন সিনেটর ট্যামি ডাকওয়ার্থ। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

কারও কারও জীবনের গল্প কল্পকাহিনিকেও ছাড়িয়ে যায়। কারও কারও লড়াই উদ্দীপনা জাগায়। প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কারও জয়ী হওয়া অন্যদের স্বপ্ন দেখায়। ট্যামি ডাকওয়ার্থ তেমনই একজন। জীবন যেখানে থেমে যাওয়ার কথা, সেখান থেকেই দ্বিগুণ উদ্দীপনা নিয়ে তিনি এগিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের হবু প্রেসিডেন্ট হিসেবে এখন তাঁকে ভাবতে ভালোবাসেন অনেকে।

মার্কিন সিনেটর ট্যামি ডাকওয়ার্থের ঝুলিতে বেশ কিছু ‘প্রথম’ রয়েছে। দুই পা হারানো ট্যামি ডাকওয়ার্থ প্রথম শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী, যিনি মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে সিনেটর নির্বাচিত হন। তিনি কংগ্রেসে প্রথম এশীয়-আমেরিকান নারী।

ব্যাংককে জন্ম নেওয়া ট্যামির মা থাই এবং বাবা আমেরিকান। এই প্রথমের ঘরে তিনি এবার আরেক ‘প্রথম’ যুক্ত করতে যাচ্ছেন। সিনেটর থাকা অবস্থায় তিনিই প্রথম নারী, যিনি মা হতে যাচ্ছেন। এক টুইট বার্তায় এই আনন্দের খবর জানিয়েছেন ৪৯ বছর বয়সী এই সিনেটর। ২০১৬ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটের হয়ে রিপাবলিকান প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়ী হন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ হিসেবে দলে তাঁর অবস্থানও বেশ পোক্ত। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই বিজয়ী নারীর কথা।

২০০৪ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে হেলিকপ্টারে কো-পাইলটের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি রকেট-প্রপেলড গ্রেনেড (রকেট চালিত গ্রেনেড) হামলার শিকার হয়ে পা হারান।

ডাকওয়ার্থের কাছে যখন ইরাকে যাওয়ার ডাক আসে, তখন তিনি ইলিনয় ন্যাশনাল গার্ডের ক্যাপ্টেন ছিলেন। যদিও সেটিকে যুদ্ধ বলে মানতে চান না। তবে ইরাকে যাওয়া ও যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন তিনি। ওই সময় তাঁর ইরাকে যাওয়ার কথা নয়। কারণ নির্দিষ্ট ওই ইউনিটের দায়িত্বে তখন তিনি ছিলেন না। এরপরও তাঁকে যেতে বলা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আপনি কাউকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাইবেন না, আপনি নিজেও সে ঝুঁকিতে পড়তে চাইবেন না, অথচ সেই ঝুঁকি কিন্তু আপনাকে মোকাবিলা করতে হবে।’

২০০৪ সালের নভেম্বরে ডাকওয়ার্থ একদিন নিয়মিত অভিযানে বেরিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীকে বাগদাদ থেকে ২০ মাইল উত্তরে তাজি থেকে মার্কিন সেনাদের নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। তাঁরা যখন সেখানে পৌঁছান, ততক্ষণে সেনারা সেই স্থান ছেড়ে চলে গেছেন। তাই তাঁরা আরও ৩০ মাইল উত্তরে বালাদে তাঁদের ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ডাকওয়ার্থ তখন কো-পাইলট ড্যান মিলবার্গের সঙ্গে ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারটি চালানোর নিয়ন্ত্রণ নেন।

চোরাগুপ্তা হামলা এড়াতে তাঁরা পাম গাছের ওপর দিয়ে কিছুটা নিচ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় হেলিকপ্টারে গুলিবর্ষণের শব্দ শুনতে পান। হেলিকপ্টারে হামলার তথ্য দিতে তিনি তখন জিপিএস পাওয়ার জ্য সামনের দিকে ঝুঁকে যান। ওই সময় গ্রেনেড ডানদিকে তাঁর কোলে এসে পড়ে এবং তাঁর ডান পায়ের ওপর বিস্ফোরিত হয়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তিনি বুঝতেই পারেননি যে তাঁর পা নেই। যতবার জ্ঞান ফিরছিল, ততবার তিনি হেলিকপ্টারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন, কেন তিনি তা করতে পারছেন না।

সিনেটর হিসেবে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে শপথ নিচ্ছেন ট্যামি ডাকওয়ার্থ। পাশে কন্যা আবিগেইল, মা লামাই ও স্বামী ব্রায়ান। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সিনেটর হিসেবে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে শপথ নিচ্ছেন ট্যামি ডাকওয়ার্থ। পাশে কন্যা আবিগেইল, মা লামাই ও স্বামী ব্রায়ান। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

সহকর্মী ড্যান মিলবার্গ হেলিকপ্টারটি চালিয়ে আনেন এবং ডাকওয়ার্থকে বের করে নিয়ে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন, ডাকওয়ার্থ মারা গেছেন। এরপরও তিনি তাঁকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দ্রুত হেলিকপ্টার থেকে বের করে আনেন। ১১ দিন পর জ্ঞান ফেরে ডাকওয়ার্থের। গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। একই সঙ্গে ক্ষোভ। তিনি দুই পায়ের সঙ্গে ডান হাতের বেশির ভাগ অংশও হারিয়েছিলেন। তাঁর শরীরে বেশ কিছু অস্ত্রোপচার করা হয়। ১৩ মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ সময় কেটেছে তাঁর ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াল্টার রিড মেডিকেল সেন্টারে। হাসপাতালটি আফগানিস্তান ও ইরাকে আহত মার্কিন সেনাদের দিয়ে ভর্তি থাকত। ওই হাসপাতাল নিয়ে ডাকওয়ার্থ ব্যঙ্গ করে বলতেন, ‘অঙ্গ হারানো মানুষদের সযত্নে রাখা চিড়িয়াখানা’, যেখানে রাজনীতিবিদেরা ছবি তোলার সুযোগ খোঁজেন।

তবে পা হারানো নিয়ে পরে তাঁর আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ‘ভাই, আমার পা কোথায়?’—এমন লেখা টি শার্ট পরে তাঁকে কৌতুক করতেও দেখা যায়।

বংশ পরম্পরায় ডাকওয়ার্থের পরিবার সামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছে। তাঁর বাবা ফ্রাঙ্ক যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

শৈশবে যুদ্ধের স্মৃতি আর বাবার চাকরি হারানোর পর কঠিন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছে তাঁকে। দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের খাদ্য সহায়তা নিয়ে তাঁদের জীবন চালাতে হয়েছে। তাঁর এই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটে কংগ্রেসেও। ২০১৩ সালে কংগ্রেসে খাদ্য সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন তিনি। অনটনের মধ্য দিয়ে বড় হওয়া ডাকওয়ার্থ পরে বিভিন্ন অনুদান ও ঋণের মাধ্যমে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। এক বন্ধুর উৎসাহে তিনি যোগ দেন সামরিক বাহিনীতে। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সহকর্মী ব্রায়ান বাউলসবের সঙ্গে। পরে বিয়ে করেন দুজন।

কয়েকটি দিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ডাকওয়ার্থের মিল রয়েছে। মিশ্র বংশীয় পরিচয় কীভাবে তাঁদের ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করেছে, তা সবার কাছে স্বীকৃত। দুজনেই ইন্দোনেশিয়ায় বড় হয়েছেন এবং পরে এশিয়া ছেড়ে হাওয়াইয়ে বাস করেছেন। বারাক ওবামার পুরোনো সিনেট আসনটিতে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট তাঁকে বলতেন, ‘বড় হৃদয়ের অধিকারী কঠিন নারী’।

চিকিৎসা, পুনর্বাসন চলার মধ্য দিয়েই ডাকওয়ার্থের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে। ২০০৫ সালে স্টেট অব ইউনিয়নে ভাষণ দেওয়ার জন্য ইলিনয়ের ডেমোক্র্যাট সিনেটর ডিক ডার্বিন তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। সেখান থেকেই রাজনীতিতে আগ্রহ জেগে ওঠে তাঁর। ২০০৬ সালে ইলিনয়ের তিনি কংগ্রেসের জন্য নির্বাচন করেন। তবে মাত্র পাঁচ হাজার ভোটে হেরে যান রিপাবলিকান প্রার্থী পিটার রসকামের কাছে। ওই নির্বাচনের ফলাফলে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন জানিয়ে ডাকওয়ার্থ বলেন, ‘আমি বাথটাবে বসেছিলাম এবং তিন দিন ধরে কেঁদেছিলাম।’

২০০৮ সালে ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ডাকওয়ার্থ। ছবি: এএফপি।
২০০৮ সালে ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ডাকওয়ার্থ। ছবি: এএফপি।

পরের বছরগুলোতে ডাকওয়ার্থ ন্যাশনাল গার্ডে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি ইলিনয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ভেটারেনস অ্যাফেয়ার্সে যোগ দেন পরিচালক হিসেবে। সামরিক বাহিনীর পুরোনো কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেখভাল করা এই বিভাগের কাজ।

২০০৮ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ডাকওয়ার্থকে তিনি ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট অব ভেটারেনস অ্যাফেয়ার্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০১২ সালে ইলিনয়ের অপর এক জেলা থেকে আবার নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেন তিনি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডাকওয়ার্থের সামরিক বাহিনীর হয়ে ভূমিকা পালন নিয়ে প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে সমালোচিত হন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রিপাবলিকান জো ওয়ালশ ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে সাবেক স্ত্রী সন্তান প্রতিপালনে যথাযথ অর্থ না দেওয়ার অভিযোগ করলে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা নামে। ওই নির্বাচনে ডাকওয়ার্থ জয়ী হন ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে। আর ওয়ালশ পান ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

পরবর্তী সময়ে মা হওয়ার লড়াইয়ে নামেন তিনি। গর্ভধারণে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) চিকিৎসা চলছিল তাঁর। তবে অনেকগুলো চেষ্টা অসফল হওয়ার পর তিনি গর্ভধারণ করেন। ৪৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম মা হন। আবিগেইল নামে জন্ম দেন এক কন্যা সন্তানের।

২০১৬ সালে সিনেট আসনের জন্য মার্ক কিরকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন ডাকওয়ার্থ। তবে লড়াইটা সহজ ছিল না। অনেক সমালোচনার মধ্য দিয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে।

ট্রাম্পের কঠোর সমালোচক হিসেবে বেশ আলোচিত এই সিনেটর। বিশেষ করে সামরিক ও অভিবাসন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা রয়েছে তাঁর। উত্তর কোরিয়া নিয়ে ট্রাম্পের আচরণের কঠোর সমালোচনাও করেন তিনি। তাঁর মতে, ট্রাম্প যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করছেন। তিনি সতর্ক করেন এই বলে যে, পরিস্থিতি এমন হলে ৮৫ হাজার মার্কিন সেনা নামাতে হবে। আর লাখ লাখ নিরীহ মানুষ বিপদে পড়বে।

প্রেসিডেন্টকে নিয়ে সমালোচনামুখর ডাকওয়ার্থকে ২০২০ সালে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্যও ভাবা হচ্ছে। যদিও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো আগ্রহ দেখাননি তিনি। তবে একটি বিষয়ে তিনি নিশ্চয় সচেতন আছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এই তাৎপর্যপূর্ণ ‘প্রথম’ এখনো অর্জিত হয়নি। আর তা হচ্ছে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট।