মালদ্বীপে নাক গলাবে ভারত?

রাজধানী মালের রাস্তায় নেমেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, পার্লামেন্টসহ অভিযান চলেছে সুপ্রিম কোর্টেও। ছবি: রয়টার্স
রাজধানী মালের রাস্তায় নেমেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, পার্লামেন্টসহ অভিযান চলেছে সুপ্রিম কোর্টেও। ছবি: রয়টার্স

১৯৮৮ সাল। মালদ্বীপের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের আহ্বানে ভারতীয় প্যারাট্রুপাররা অভিযান চালিয়েছিল দেশটিতে। শ্রীলঙ্কার মার্সিনারিদের বিরুদ্ধে চালানো অপারেশন ক্যাকটাসের পর আরও ২০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মামুন। এবার তিনি বিরোধী দলে। ফের উঠেছে দ্বীপদেশটিতে ভারতের হস্তক্ষেপের দাবি। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে তা কি আদৌ সম্ভব?

মালদ্বীপের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট বেশ জটিল। দেশটিতে এক সপ্তাহেই অনেক কিছু ঘটে গেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আদালতের রায় না মেনে উল্টো ১৫ দিনের জন্য জারি করলেন জরুরি অবস্থা। গ্রেপ্তার করা হলো সর্বোচ্চ আদালতের দুই বিচারককে। তার ঠিক পরপরই পাল্টে গেল নয় রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তির বিষয়ে দেওয়া আদালতের রায়।

আদালতের প্রাথমিক আদেশকে ‘ক্যু প্রচেষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন। ছবি: এএফপি
আদালতের প্রাথমিক আদেশকে ‘ক্যু প্রচেষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন। ছবি: এএফপি

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আদালতের রায় প্রত্যাহার হওয়ায় এখন কিছুটা স্বস্তিতে আছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন। কিন্তু আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরাশক্তিদের নিয়ে ঠিক ততটাই অস্বস্তিতে আছেন তিনি। আবদুল ইয়ামিনের মাথাব্যথার মূল কারণ এখন ভারত। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন মালদ্বীপের সর্বোচ্চ আদালত যখন নয় রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তির আদেশ দিলেন, তখনই আদালতের আদেশ মেনে চলার কথা বলেছিল ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, ইয়ামিন সরকারের কর্মকাণ্ডে ‘বিরক্ত’ তারা। মালদ্বীপের সরকারের প্রতি কঠোর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘও।

সর্বোচ্চ আদালত ও সরকারের মধ্যে এই সংকটের শুরু ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। সেদিন এক ঐতিহাসিক আদেশে মালদ্বীপের সুপ্রিম কোর্ট সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ বিরোধীদলীয় নয়জন রাজনৈতিক বন্দীকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দেন। এসব রাজনৈতিক বন্দীর বিরুদ্ধে করা মামলাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দেন আদালত। বহিষ্কৃত ১২ জন আইনপ্রণেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনার আদেশও দেওয়া হয়। এটি মানা হলে দেশটির ৮৫ সদস্যের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো।

কিন্তু সেই আদেশ না মেনে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের চেষ্টায় আছেন সুপ্রিম কোর্ট। একে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আদালতের আদেশ মেনে না চলার আহ্বান জানানো হয়। এরপর রাজধানী মালের রাস্তায় নামে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন সরকারি কার্যালয় ও পার্লামেন্ট কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। একপর্যায়ে অভিযান চলে সুপ্রিম কোর্টেও। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে আটক করা হয়েছে প্রধান বিচারপতি আবদুল্লাহ সাইদসহ দুই বিচারপতিকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকে। আদালতের প্রাথমিক আদেশকে ‘ক্যু প্রচেষ্টা’ অভিহিত করে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন বলেছেন, বিরোধীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে রায় দিয়েছিলেন আদালতের এই বিচারকেরা। জরুরি অবস্থা জারি না হলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত না।

তবে বিরোধীরা মানছে না প্রেসিডেন্টের দাবি। তাদের বক্তব্য, দেশটিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে এবং বর্তমান সংকটের জন্য একমাত্র দায় আবদুল্লাহ ইয়ামিনের। ১৯৮৮ সালের মতো এবারও ভারতকে পাশে চান তাঁরা। ভারতকে ‘মুক্তিদাতা’ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ভারত দখলকারী ছিল না, তারা মুক্তিদাতা। আর তাই মালদ্বীপের অধিবাসীরা এখন ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে।’

সংকটের সিঁড়ি
প্রায় ৩০ বছর মালদ্বীপে চলেছে একনায়কত্ব। ১৯৭৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দ্বীপদেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম। তাঁর বিরুদ্ধে ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ। ২০০৮ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ নাশিদ। কিন্তু বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি তিনি। ২০১২ সালে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয় তাঁকে। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠতে থাকে মালদ্বীপের রাজনীতি।

২০০৮ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ নাশিদ। এখন স্বেচ্ছানির্বাসনে আছেন তিনি। দল চালাচ্ছেন শ্রীলঙ্কা থেকে। ছবি: এএফপি
২০০৮ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন মানবাধিকারকর্মী মোহাম্মদ নাশিদ। এখন স্বেচ্ছানির্বাসনে আছেন তিনি। দল চালাচ্ছেন শ্রীলঙ্কা থেকে। ছবি: এএফপি

পরের বছর আয়োজিত নির্বাচনের প্রথম ধাপে বেশি ভোট পেয়েছিলেন মোহাম্মদ নাশিদ। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ভোট বাতিল করে দিলে পথ খোলে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের। ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আরোহণ করেন তিনি। এরপর সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তোলা হয় নাশিদের বিরুদ্ধে। দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন তিনি এবং দাবি করেন যে এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ওই অভিযোগেই নাশিদকে দেওয়া হয় ১৩ বছরের কারাদণ্ড। এর ফলে নির্বাচনে অংশ নেওয়াও অসম্ভব হয়ে উঠেছে নাশিদের জন্য।

২০১৫ সালে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে ভাইস প্রেসিডেন্টসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধীরে ধীরে নিজের একাধিপত্য বিস্তার করেন ইয়ামিন। চীন ও সৌদি আরবের সমর্থনে ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত করে বিরোধীদের কোণঠাসা করায় মনোযোগ দেন তিনি। আর এর বদলে চীন ও সৌদি আরবকে দেওয়া হয় মালদ্বীপে অবাধ বিনিয়োগের সুবিধা। এর মধ্যে চীনের নৌবাহিনীর জাহাজকে মালেতে নোঙর করার সুযোগ দিয়ে কার্যত ভারতের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন।

কোণঠাসা হয়ে গত বছরের মার্চে হাত মেলান গাইয়ুম ও নাশিদ। দ্য ইনডিপেনডেন্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন হলে এই বিরোধীদলীয় জোটের না জেতার কোনো কারণ নেই। আর ঠিক সেই পরিস্থিতিতেই মরিয়া হয়ে ওঠেন ইয়ামিন।

গত বছরের নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইয়ামিন। কিন্তু ১২ জন আইনপ্রণেতা তাঁর দল থেকে পদত্যাগ করে বসেন। ওই সময় আদালত আদেশ দিয়েছিলেন যে দলত্যাগী আইনপ্রণেতাদের পার্লামেন্ট আসন অবশ্যই শূন্য রাখতে হবে।

এ পর্যন্ত সবই ছিল বর্তমান প্রেসিডেন্টের অনুকূলে। কিন্তু চলতি মাসে আদালতের উল্টো আদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর শঙ্কায় পড়েন প্রেসিডেন্ট। শেষতক সেনাসদস্যদের দিয়ে পার্লামেন্ট ‘ঘেরাও’ করে সেই ‘শঙ্কা’ উড়িয়ে দিলেন ইয়ামিন।

ভারত কি হস্তক্ষেপ করবে?
ভূরাজনৈতিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে মালদ্বীপ। ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বৈরথ চলছে ভারত ও চীনের মধ্যে। শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের মতো মালদ্বীপেও প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভারত-চীন। তবে দ্বীপদেশটিতে বিনিয়োগে এগিয়ে আছে চীন ও সৌদি আরব।

মালদ্বীপ আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দেশটিতে দিন দিন মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। দ্য ইনডিপেনডেন্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুলনামূলক হিসাবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে (আইএস) সবচেয়ে বেশি সদস্য যোগ দিয়েছে মালদ্বীপ থেকে। ক্ষমতা সংহত করতে গিয়ে মৌলবাদের হুমকি মোকাবিলায় কোনো পদক্ষেপই নেয়নি দেশটির সরকার।

প্রায় ৩০ বছর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম। তাঁর বিরুদ্ধে ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ। ছবি: এএফপি
প্রায় ৩০ বছর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম। তাঁর বিরুদ্ধে ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগ। ছবি: এএফপি

প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের পাশে আছে চীন। মালদ্বীপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে থাকা মতভিন্নতা ‘আলোচনা ও মধ্যস্থতা’র মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেছে চীনের সরকার। প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন পাশে পাচ্ছেন সৌদি আরব ও পাকিস্তানকেও। এরই মধ্যে জরুরি অবস্থা জারির কারণ বোঝাতে এই তিন দেশে ‘বিশেষ দূত’ পাঠিয়েছেন ইয়ামিন। তবে দূত যায়নি ভারতে। ভারতে নিযুক্ত মালদ্বীপের হাইকমিশনার অবশ্য দাবি করেছেন, ভারতের আপত্তির কারণেই বিশেষ দূত যেতে পারেননি সেখানে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লাইভ মিন্টে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারত সরকার শুরুতে মালদ্বীপে থাকা ভারতীয় পর্যটক ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। মূলত ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন দিতে চায় ভারত সরকার। এ ক্ষেত্রে সামরিক হস্তক্ষেপের চেয়ে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা নিয়েই ভাবা উচিত মোদি সরকারের। কারণ, বর্তমান দুনিয়ায় প্রতিবেশী দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালোভাবে নেবে না।

সিএনএন-নিউজ এইটটিনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যম ভারত সহজেই মালদ্বীপে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু এটি ১৯৮৮ সাল নয়। সামরিক হস্তক্ষেপ করা মাত্রই চীন ও পাকিস্তানের মোকাবিলা করতে হবে ভারতকে। সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, মালদ্বীপের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থা করা এবং এতে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবকে পাশে লাগবে ভারতের।

লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে প্রকাশিত খবরে বিশ্লেষক আব্বাস ফাইজ লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনকে সমর্থন দিচ্ছে মালদ্বীপের সেনাবাহিনী। আবার তাঁর নিজের সমর্থক গোষ্ঠীও আছে। সুতরাং তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো এত সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে চীনের বর্তমান নীতির পরিবর্তন না হলে ইয়ামিনকে হটানো কঠিন।’

আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ভারত ও চীন-দুই দেশই বলেছে, তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। এই দুই দেশের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে কত দিন টিকে থাকেন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।