সুভাষিণীর 'পদ্মশ্রী' পাওয়ার গল্প

সুভাষিণী মিস্ত্রি। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী, কলকাতা
সুভাষিণী মিস্ত্রি। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী, কলকাতা

স্বামীর অকালমৃত্যুতে নিরুপায় তিনি। সঙ্গে চার শিশুসন্তান। এক কথায় অথই সাগরে ঝপাৎ। কিন্তু তিনি হাবুডুবু খাননি। বুকে সাহস বেঁধে লড়েছেন। জয়ী হয়েছেন জীবনসংগ্রামে। মুঠোয় এসেছে ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পদ্মশ্রী।

এই মহিয়সী সুভাষিণী মিস্ত্রি। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। থাকেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরের অদূরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার হাঁসপুকুরে। বাংলাদেশে ছিল তাঁর আদি পুরুষদের ভিটা।

১৯৭১ সালে হঠাৎ করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান সুভাষিণীর স্বামী সাধন চন্দ্র মিস্ত্রি। তখন তাঁর কোলে নাবালক চার সন্তান। দুই মেয়ে আর দুই ছেলে। উত্তরা (৯), সুজয় (৫), অজয় (৪) ও বিফলা (১ বছর ৬ মাস)। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না এই নারী। এই চার সন্তানকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন সুভাষিণী। বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে বাঁচতে হবে। কিন্তু তাতে কি পেট চলবে? অগত্যা চার সন্তানকে চারটি অনাথ আশ্রমে তুলে দেন সুভাষিণী। কিন্তু বড় মেয়ে উত্তরা থাকতে পারছিল না সেখানে। তাকে রাখলেন নিজের কাছে।

আর সুভাষিণী? শুরু করেন তাঁর জীবনসংগ্রাম। বলছিলেন প্রথম আলোকে, ‘কিই-না করেছি বাঁচার জন্য? পরের বাড়ির ঝিগিরি থেকে চায়ের দোকানে কাজ, ঢালাইয়ের কাজ, ছাদ পেটানোর কাজ, ধাপায় কয়লা কুড়ানোর কাজ, মাছের ঘেরে কচুরিপানা পরিষ্কার করার কাজ, জমিতে চারা বসানোর কাজ, ধান চাষ, আরও কত-কি? শেষ পর্যন্ত সবজি বেচার কাজ।’

সুভাষিণী সবজি বেচাকেনা করে খুঁজে পান বাঁচার পথ। সেই হাঁসপুকুর থেকে কলকাতার পার্ক সার্কাসের ৪ নম্বর ব্রিজের কাছে চৌবাগায় অস্থায়ী জায়গায় সবজি বেচে শুরু করেন জীবনসংগ্রাম। অন্যদিকে অনাথ আশ্রমে মানুষ হতে থাকে তিন সন্তান। বড় মেয়ে হয়ে যান তাঁর সঙ্গী। সবজি বেচার সঙ্গী। সুভাষিণী বলেন, ‘পাইকারি বাজার থেকে সবজি কিনে তা মাথায় নিয়ে ফুটপাতে বসে বিক্রি করেছি।’

সুভাষিণী মিস্ত্রি জমানো টাকা দিয়ে হাঁসপুকুরে ১৯ কাঠা জমি কেনেন। তাঁর স্বপ্ন, এখানেই গড়বেন একটি হাসপাতাল। এই জমিতেই ১৯৯৩ সালে একটি অস্থায়ী ঘর তৈরি করে শুরু করেন একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

সুভাষিণী বলছিলেন, ‘এরপর মানুষ আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ১৯৯৬ সালে ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে গড়ে তুলি হাসপাতাল। নাম দেওয়া হয় হিউম্যানিটি হাসপাতাল।’

সুভাষিণীর লড়াইয়ের ফসল কমিউনিটি হাসপাতাল। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী, কলকাতা
সুভাষিণীর লড়াইয়ের ফসল কমিউনিটি হাসপাতাল। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী, কলকাতা

তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কে ভি রঘুনাথ রেড্ডি এই হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। তারপর থেকে এই হাসপাতাল সুভাষিণী দেবীর হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। এখন এই হাসপাতাল ভবন তিনতলা হয়েছে। এখানে রয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ৪৫ শয্যার এই হাসপাতালে রয়েছে ১০টি আইসিসিইউ শয্যা। প্যাথোলজির সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এখানে এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, হল্টার, টিএমটি, ইইজি, ইসিজি, ইকোসহ রক্তের নানা পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। রয়েছেন ১৪ জন নার্সসহ অন্যান্য কর্মচারী, কর্মী। রয়েছে অ্যাম্বুলেন্সও।

সুভাষিণী বলেন, ‘এখন আমার স্বপ্ন এই হাসপাতালকে আরও বড় করা। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা। এখানে হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা থেকে বেশ কজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তো আর টাকা দিয়ে বড় ডাক্তার রাখতে পারছি না। তবু বেশ কজন চিকিৎসক বিনা মূল্যেই চিকিৎসা করে যাচ্ছেন গরিব রোগীদের সেবার মানসিকতা নিয়ে।’

হাসপাতালের চিকিৎসক এস পি চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘মানবিক কারণেই আমি এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা থেকে যুক্ত রয়েছি। ভালো লাগে এখানে গরিবদের চিকিৎসাসেবা দিতে পেরে। যদিও গরিবদের জন্য এই হাসপাতালে কোনো অর্থ নেওয়া হয় না, বেডভাড়াও নেওয়া হয় না। এখানে অপারেশনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে অপারেশন থিয়েটারও।’

সুভাষিণীর ছোট ছেলে অজয় মিস্ত্রি রসায়নে অনার্স পাস করে এখন হাসপাতালের হাল ধরেছেন। তিনিই এখন হাসপাতাল দেখভাল করছেন। গত বছর হঠাৎ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বড় ছেলে। তাঁর ছেলে মহাদেব মিস্ত্রি অবশ্য এখনো পূর্বপুরুষের সবজির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুভাষিণীর ছোট মেয়ে সুফলা হাসপাতালের নার্স হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই হাসপাতাল গড়তে গিয়ে সুভাষিণী পেয়েছেন বিভিন্ন মানুষ ও সংস্থার আর্থিক সহায়তাও।

২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর যখন সুন্দরবন লন্ডভন্ড হয়, তখনই সুভাষিণীর দৃষ্টি পড়ে সুন্দরবনের দিকে। সেখানের শান্তিগাছিতে গড়ে তোলেন দ্বিতীয় হিউম্যানিটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতালেও রয়েছে রোগী চিকিৎসার ২৫টি শয্যা। ২০১৪ সালে এই হাসপাতাল পূর্ণতা পায়। এখানে প্রথম দিকে অস্থায়ী ঘরে চলছিল প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র।

সুভাষিণী মিস্ত্রির মানুষের কল্যাণে নিবেদিত এ কাজের এবার স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত সরকার। ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী পেয়েছেন তিনি। এই খবরে দারুণ খুশি সুভাষিণী। বলেছেন, ‘এই পদক আমাকে আরও বড় করে এই হাসপাতাল গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা জোগাবে। আমি চাই ভারত সরকার এগিয়ে আসুক এই হাসপাতালকে আরও বড় করার জন্য। এতে করে এই অঞ্চলের গরিব মানুষ আরও বেশি করে চিকিৎসার সুযোগ পাবে।’

সুভাষিণী মিস্ত্রিকে পদ্মশ্রী পদক দেওয়ার ঘোষণার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের সুভাষিণী মিস্ত্রি এমনই একজন নারী, যিনি লোকের বাড়িতে বাসন ধুয়ে, সবজি বিক্রি করে গরিবদের চিকিৎসার জন্য তাঁর স্বপ্নের হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন।’ এভাবেই ওই দিন সুভাষিণীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী মোদি।

৮০ বছরের সুভাষিণীর যুদ্ধ থেমে যায়নি এখনো। সুন্দরবনে হাসপাতাল গড়ার পর তিনি তাঁর কলকাতার নিউম্যানিটি হাসপাতালের পাশে গড়ে তুলেছেন তিনতলাবিশিষ্ট একটি বৃদ্ধাশ্রমও। আগামী মার্চ মাসে এই বৃদ্ধাশ্রম চালু করা কথা বলেছেন সুভাষিণী।