ভারতে সেনাদের পেছনে টাকার শ্রাদ্ধ কেন?

সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ভারত এখন ৫টি শীর্ষ দেশের মধ্যে। ছবি: এএফপি
সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ভারত এখন ৫টি শীর্ষ দেশের মধ্যে। ছবি: এএফপি

দোকলাম সীমান্ত ও মালদ্বীপের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্য চাপান-উতোর যেন নিয়মিত ব্যাপার। বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে কে বিনিয়োগ করবে, তা নিয়ে নানা আলোচনার পর ভারত নয়, সুযোগ পেল চীন। এমন অনেক কিছু নিয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশ দুটি। এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে দুই দেশের চেষ্টাও নিরন্তর। এ জন্যই বোধ হয় সামরিক খাতে দিন দিন বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি দেশীয় প্রযুক্তির অস্ত্রও তৈরি বাড়িয়েছে দেশ দুটি। তবে সামরিক খাতে ভারতের সাম্প্রতিক সময়ের ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে অনেক দেশের মতো চীনকে নিশ্চয়ই ব্যাপারটি আমলে নিতে হবে।

বিশ্বে নিজ প্রভাব-প্রতিপত্তি জানান দিতে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ছে। পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর বাইরেও অনেক দেশই সামরিক খাতে দিন দিন তাদের খরচ বাড়াচ্ছে। সামরিক শক্তিকে বিশ্বের শক্তির আধার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সামরিক শক্তি বাড়াতে একে অপরকে পেছনে ফেলতে কয়েকটি দেশ উঠেপড়ে লেগেছে। বছর বছর বাড়ানো হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটা। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে ভারত ও চীন।

‘দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০১৮’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)। এ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ভারতের সামরিক বাজেট যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন দেশটি সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্য আছে। আর শীর্ষ পাঁচে ভারত ঢুকে পড়ায় প্রথমবারের মতো শীর্ষ পাঁচ থেকে বের হয়ে গেছে যুক্তরাজ্যর মতো দেশ। গত বছরে সামরিক খাতে ভারতের ব্যয় ছিল ৫ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। ২০১৬ সালে এ খাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ১১০ কোটি ডলার।

এনডিটিভির খবরে বলা হয়, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদি সরকার ৫ হাজার ৫৭ লাখ ডলারের সামরিক অস্ত্র বিদেশ থেকে কেনে। এ বছরের ফ্রান্সের রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনতে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরোয় একটি চুক্তি করে ভারত। ভারতীয় মুদ্রায় যা ৫৮ হাজার কোটি রুপির মতো। মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত তাদের প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যয় করছে সামরিক খাতে। দেশীয় সামরিক সরঞ্জাম তৈরিও বৃদ্ধি করেছে।

সিএনএনের খবরে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের সামরিক খাতে ব্যয় ২০১৬ সালে ছিল ৫ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। আর গত বছরে তা কমে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭০ কোটি ডলারে।

২০১৭ সালে সামরিক খাতে ভারতের ব্যয় ছিল ৫ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। ২০১৬ সালে ছিল ৫ হাজার ১১০ কোটি ডলার। ছবি: ডিফেন্স নিউজ
২০১৭ সালে সামরিক খাতে ভারতের ব্যয় ছিল ৫ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। ২০১৬ সালে ছিল ৫ হাজার ১১০ কোটি ডলার। ছবি: ডিফেন্স নিউজ

এ ব্যাপারে আইআইএসএসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ফেলো রাহুল রায় চৌধুরী পিটিআইকে বলেন, ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সামরিক ভারসাম্য পর্যালোচনার পর দেখা যাবে, গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো যুক্তরাজ্যর চেয়ে ভারত তার আঞ্চলিক সম্পদ বিকাশে অধিকতর সামর্থ্য রাখে।

আইআইএসএসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারত তার সামরিক সক্ষমতা দিন দিন আধুনিকায়ন করছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিরক্ষা বাজেটের দেশ চীন ভারতের চেয়ে তিন গুণ বেশি সামরিক খাতে ব্যয় করছে, এর পরিমাণ হচ্ছে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। সামরিক খাতে ব্যয়ের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া ও ভারত। বর্তমান সময়ে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যাওয়া তৃতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরবের সামরিক খাতে ব্যয় যে চোখ কপালে ওঠার মতোই। ৭ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার এ খাতে ব্যয় করে সালমানের সৌদি আরব।

চীন ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে ২৫ শতাংশ, যেখানে ভারত বাড়িয়েছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। রাহুল রায় চৌধুরী বলছিলেন, ‘দোকলাম ঘটনার পরে চীন ও ভারতের মধ্যকার সামরিক ভারসাম্যর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে গেছে চীন। ২০০০ সালের পর থেকে দেশটি অধিক সাবমেরিন, রণতরি, রণতরি বিধ্বংসী জাহাজ, মাঝারি আকারের যুদ্ধজাহাজ তাদের প্রতিরক্ষা খাতে যুক্ত করেছে। চীনের সামরিক খাতে এ সংযোজন যৌথভাবে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের চেয়ে বেশি। পাশাপাশি চীন এ অঞ্চলে মার্কিন প্রতিরক্ষা খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চীনের সেনাবাহিনীতে ভারতের চেয়ে ছয় লাখ বেশি সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে। যেখানে চীনের ১ হাজার ২০০ কৌশলগত বিমান আছে, সেখানে ভারতের আছে ৭৮৫টি। ক্রুজ, ধ্বংসাত্মক ক্রুজ-ফ্রিগেটও ভারতের চেয়ে ৫৫টি বেশি আছে চীনের।

প্রতিবেদনে ভারত সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতির প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। এই নীতির লক্ষ্য হচ্ছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে পুনঃপ্রতিষ্ঠার (এফডিআই) পাশাপাশি প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করা এবং ভারত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানের শীর্ষস্থানের দেশের মর্যাদা ধরে রাখা।

রাহুল রায় চৌধুরী বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র না পাওয়ার সীমাবদ্ধতা কিন্তু আছে। এ ছাড়া গোলাবারুদ এবং খুচরা যন্ত্রাংশের ঘাটতিও বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ক্রমবর্ধমান হারে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বাড়ছে।

সর্বোপরি এ প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য দেখা যাচ্ছে যে সামরিক খাতে চীন ও রাশিয়ার প্রত্যকের বাজেট ৬ হাজার ১২০ কোটি ডলার। দেশ দুটি সামরিক ব্যয়ে শীর্ষে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ বছরে ৬০ হাজার ২৮০ কোটি ডলার খরচ করে সামরিক খাতে। তবে এ কথা সত্য যে মিত্র দেশগুলো এত দিন ধরে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এসেছে, দিন দিন চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাওয়ায় তা ভবিষ্যতে ধরে রাখা কঠিন হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।

চীন নিজ সামরিক বহরে দিন দিন যুক্ত করছে নতুন নতুন যুদ্ধবিমান। ছবি: সংগৃহীত
চীন নিজ সামরিক বহরে দিন দিন যুক্ত করছে নতুন নতুন যুদ্ধবিমান। ছবি: সংগৃহীত


যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের চ্যালেঞ্জ চীন-রাশিয়া
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের জন্য নিজেদের তৈরি করছে চীন ও রাশিয়া। মার্কিন ও তাদের মিত্ররা এ ক্ষেত্রে যে কৌশলগত সুবিধা এত দিন ভোগ করেছিল, এখন তারা তা আর পারবে না। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান আইআইএসএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ অপরিহার্য না হলেও একটি সম্ভাব্য সংঘাতের পথে পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে ওয়াশিংটন, মস্কো ও বেইজিং।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২০ সালের মধ্যে চীনের সামরিক বহরে যুক্ত হবে যুদ্ধবিমান চেংদু জে-২০। এদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে। এ ছাড়া আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পিএল-১৫ আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। নৌবাহিনীও আধুনিকায়ন করছে চীন। গত ১৫ বছরে চীন এ কর্মসূচিতে অনেক নতুন নতুন অস্ত্র যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অধিকতর রণতরি, ডেস্ট্রয়ার, যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন। জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া তিন দেশের মোট যে পরিমাণ সামরিক অস্ত্র রয়েছে এক চীনের কাছে তার চেয়েও বেশি আছে। আছে নতুন নতুন যুদ্ধবিমান। তাদের নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে টাইপ-০৫৫ ক্রুজার। এটি ইউরোপের উপকূলে মোতায়েন হতে পারে। নতুন যে সুপারসনিক বিমান তৈরি করছে দেশটি, সেটি যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে সক্ষম। তবে সামরিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ হওয়া রাশিয়া এ ক্ষেত্রে ধীরগতিতে হাঁটছে। হয়তোবা তহবিলসংকট দেশটির একটি কারণ। শিল্পসংক্রান্ত জটিলতাও আছে। কারণ, পুতিনের দেশটি সিরিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। তবে তারা সাইবার হামলার সক্ষমতা অর্জন করছে।