ত্রিপুরায় গেরুয়া ঝড়ের কারণ কী?

বিজেপি
বিজেপি

বিজেপি যেখানে কখনো লড়াই করার জন্য মাথা তুলতে পারেনি, সেখানে হঠাৎ কী হলো? ভোটের ফলের পর এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে উৎসুক ব্যক্তিদের মনে। টানা ২৫ বছর ধরে ত্রিপুরা বামদের দখলে ছিল। লাল সরকারের শাসনে অভ্যস্ততাও ছিল জনগণের। বিশেষ করে সাদামাটা জীবন যাপন করে যাঁর নাম ছড়িয়ে ছিল, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সেই মানিক সরকারের জনপ্রিয়তা নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন ছিল না। সিপিএমের টানা ২৫ বছরের শাসনের মধ্যে ২০ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সেই ত্রিপুরায় লাল সরকার বিজেপির গেরুয়া ঝড়ে উড়ে গেল।

আগামী পাঁচ বছরের জন্য সেখানে শাসন শুরু করতে যাচ্ছে বিজেপি। ত্রিপুরা জয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের ২০তম রাজ্যে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। আজ শনিবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত হিসাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার দল আইপিএফটির সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপি পেয়েছে ৪১টি আসন। অন্যদিকে সিপিএম পেয়েছে ১৮টি আসন।

ভারতের উত্তর-পূর্বের বাঙালি–প্রধান ত্রিপুরা রাজ্যের বিধানসভায় মোট ৬০টি আসন। এর মধ্যে একটি আসনে বামফ্রন্ট প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। আজ সকাল থেকে ৫৯টি আসনের ভোট গণনা হয়। সেসব আসনে নির্বাচন হয় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। আর আজ সকাল আটটা থেকে শুরু হয় ভোটগণনা।

শূন্য আসন থেকে শাসক বনে যাওয়া বিজেপির উত্থান নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বামদের শাসন পাল্টাতে ‘চলো পাল্টাই’ স্লোগানই কি শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করল? সিপিএমের টানা শাসনে ভোটাররা একঘেয়ে হয়ে শাসক পরিবর্তন করে দেখতে চাইছে কী হয়? এমনিতে বিজেপির কড়া সমালোচক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও চেয়েছিলেন ত্রিপুরায় শিকড় গেড়ে বসা বাম সরকার উৎখাত হোক। ত্রিপুরায় এর আগে কখনো কোনো আসন পায়নি বিজেপি। এবার শুরু থেকেই এই রাজ্যে জয় পেতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে দলটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ দলের কেন্দ্রীয় বাঘা বাঘা নেতা সেখানে প্রচারে নামেন। প্রচারে এসে ভোটারদের উদ্দেশে মোদি বলেছিলেন, ‘মানিক ফেলে এবার হীরা তুলে নিন!’

এই অঞ্চলে একেবারেই পাত্তা না পাওয়া কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি জয় পেতে দীর্ঘদিন ধরে এগিয়েছে। অন্য দল ভাঙিয়ে চৌকস নেতাদের নিজ দলে টেনে নিয়েছে। তাঁদের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়েছে। বামদের ঘাঁটি ভাঙতে নির্বাচনী জোট গড়তেও কৌশলী হয় দলটি। জোট ভাঙা–গড়ার খেলায় সেই নেতারা কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারে দেদার অর্থও ব্যয় করেছে দলটি। আর সব মিলিয়ে দেরিতে হলেও ফল পেয়েছে বিজেপি।

বলা হয়ে থাকে, কংগ্রেস ছেড়ে ২০১৫ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়া হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই অঞ্চলে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। ৪৯ বছর বয়সী এই নেতা জোট গড়তে তাঁর কৌশলী পদক্ষেপের কারণে প্রশংসিত হয়েছেন। এর আগে মণিপুর, আসাম ও অরুণাচলে বিজেপির সমর্থন বাড়িয়েছেন। অরুণাচল প্রদেশে হিমন্ত শর্মা কংগ্রেস বিদ্রোহীদের দল ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। ৪০ জন বিদ্রোহী নেতা কংগ্রেসে ফিরেও গিয়েছিলেন। তবে হিমন্ত শর্মার কথায় তাঁরা আবারও দল ছেড়ে দেন এবং আঞ্চলিক একটি দলে যোগ দেন। ওই দল পরে অরুণাচলে বিজেপি–সমর্থিত সরকার গঠন করে।

উত্তর–পূর্ব অঞ্চল জয়ের অভিযানে নামা হিমন্ত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ উত্তর-পূর্বে অভূতপূর্ব মনোযোগ দিচ্ছেন, এ কারণেই আমি বিজেপিতে। আমার পুরো রাজনৈতিক জীবনে আমি কোনো জাতীয় দলকে এই অঞ্চলে এত মনোযোগ দিতে দেখিনি। এই অঞ্চলের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন তাঁরা।’

এ ছাড়া কট্টর হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে বিজেপির সখ্যতাও এই অঞ্চলে জয় পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সংঘ দুর্গম এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা, সেবাসহ মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির বিষয়ে কাজ করে। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোকে টার্গেট করে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে আরএসএস। তাদের এই কাজের ফল বিজেপি পায় আসাম নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর খুব দ্রুত ত্রিপুরাসহ খ্রিষ্টানপ্রধান নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ে কাজ শুরু করে আরএসএস। এদিকে ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে যাঁকে ঘিরে, তিনিও আরএসএসে প্রশিক্ষিত ছিলেন। আরএসএসে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন সেই বিপ্লব কুমার দেব। ৪৮ বছর বয়সী বিপ্লব দেব ত্রিপুরা বিজেপির সভাপতি। ত্রিপুরা থেকে বাম হঠাতে বিজেপি ও আরএসএসের সঙ্গে ঘণিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন তিনি।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা রাম মাধব পরিবর্তনের পক্ষে ত্রিপুরার ভোটাররা ভোট দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এখানে জয় পেতে দলের নেতা-কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট প্রথম ক্ষমতায় আসে ১৯৭৭ সালে। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনেও জয় পান বামফ্রন্ট। মাঝে ১৯৮৮ সালের ভোটে জয় পায়নি দলটি। তবে ১৯৯৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর একটানা চারবার জয় পায় বামফ্রন্ট।

শাসক বাম দলকে চ্যালেঞ্জ করে বিজেপি এবার জোট গড়ে আইপিএফটির (ইনডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা) সঙ্গে।
২০১৩ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ১০টি আসন পেলেও এবার কোনো আসন পায়নি। সিপিএম ৪৯টি আসন পেয়েছিল গত নির্বাচনে। এবার পেল ১৮টি। বিজেপি আইপিএফটির সঙ্গে জোট বেঁধে পেল ৪১টি আসন।

হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি ও আনন্দবাজার পত্রিকা অবলম্বনে