রোহিঙ্গা গণহত্যায় আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারই একমাত্র পথ: ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বিচারই একমাত্র পথ। এ কথা বলেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তরের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। গতকাল বৃহস্পতিবার হাউস অব কমন্সে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে ফিল্ড এ মন্তব্য করেন।

মার্ক ফিল্ড বলেন, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম কোর্ট) স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। ফলে দেশটিকে নিজে থেকেই আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চাইতে হবে। অথবা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে তুলতে হবে। তবে ব্রিটিশ এই প্রতিমন্ত্রী মনে করেন, স্বল্পমেয়াদে এর কোনোটিই হয়তো ঘটবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যারা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি নিয়ে কাজ করছে এবং অপরাধের আলামত ও প্রমাণ সংগ্রহ করছে, তাদের প্রতি সমর্থন বন্ধ করে দিতে হবে।

মিয়ানমারে নিযুক্ত কানাডার বিশেষ দূত বব রের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাতের প্রসঙ্গ তুলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকারীরা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং তাদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বব রে। প্রতিমন্ত্রী মনে করেন, রাষ্ট্রীয়, জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যারাই অপরাধে যুক্ত হয়েছে, তাদের সবার জন্যই এই বিচার প্রযোজ্য।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথে যুক্তরাজ্যের করণীয় হিসেবে অতি জরুরি বিবেচনায় চারটি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন মার্ক ফিল্ড। এগুলোর মধ্যে আছে রাখাইন অঞ্চলের এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অতি জরুরি মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা। বিশেষ করে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের পুনর্বাসনে সহায়তা এবং আসন্ন বর্ষা মৌসুমের জন্য কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে প্রস্তুত করে তোলা।

দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে কাজ অব্যাহত রাখা। ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী জানান, সঠিকভাবে রোহিঙ্গাদের পরিচয় নির্ধারণ এবং প্রত্যাবাসন-প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পূর্ণ করতে জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশনের (ইউএনএইচআরসি) নজরদারি নিশ্চিত করতে চাপ দিয়ে যাবে যুক্তরাজ্য।

তৃতীয়ত, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচার নিশ্চিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে চাপ অব্যাহত রাখা। এ কাজে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ চাপের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।

চতুর্থ পদক্ষেপটি হলো জাতিসংঘ তদন্ত দলকে (ইউএন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন) রোহিঙ্গা নির্যাতনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র উদ্‌ঘাটনে সমর্থন দিয়ে যাওয়া। মিয়ানমার যাতে এ দলকে শর্তহীন প্রবেশের অনুমতি দেয়, সেই আহ্বান অব্যাহত রাখা। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনকে সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রাখা।

গত সোমবার জাতিসংঘের তদন্ত দল মিয়ানমারে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা নিপীড়নের ওপর তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দিয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে মার্ক ফিল্ড বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত অনুরোধ সত্ত্বেও মিয়ানমার এই তদন্ত দলকে তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে দেয়নি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত দল যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে পদ্ধতিগত নির্যাতন চালিয়ে রোহিঙ্গা নিধনের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উঠে এসেছে। উঠে এসেছে রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ, হত্যা এবং তাদের বাড়িঘর ও গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার ভয়াবহ চিত্র। এসব অপকর্মের জন্য প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার সেনাদের জড়ো হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড। তিনি বলেন, বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) উৎপাত ঠেকাতে সেনা সমাবেশ করা হয়েছিল বলে দাবি মিয়ানমারের। তাদের এই দাবি বিশ্বাস করা না করার প্রসঙ্গ এক পাশে রেখে বলা যায়, ওই সেনা সমাবেশের আসল প্রভাব ছিল সীমান্তে অবস্থানরত হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে আতঙ্কিত করা এবং বাংলাদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য করা।

প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ডের প্রতিবেদনের পর এক ডজনের বেশি এমপি মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক বিতর্কে অংশ নেন। তাঁরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।

লিভারপুলের ওয়েস্ট ডার্বি আসনের লেবার পার্টির এমপি স্টিফেন টুইগ বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের শিবির জর্ডানের জাতারি শরণার্থী ক্যাম্পের তুলনায় ১০ গুণ বড় এবং লিভারপুর শহরের দ্বিগুণ। আসন্ন বর্ষা ও কালবৈশাখীর সময়ে রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়ার আহ্বান জানাতে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান।