পশ্চিমা হামলায় আসাদের কী?

প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। ছবি: রয়টার্স
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। ছবি: রয়টার্স

রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে গত শুক্রবার সিরিয়ার তিনটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। কিন্তু এতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের কি কোনো অসুবিধে হচ্ছে? বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতে আসাদের সুবিধেই বরং বেশি। গতবারের মতো এবারও সিরীয় সংকট নিরসনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না পশ্চিমা দেশের ক্ষেপণাস্ত্র।

ঘটনার শুরু এক সপ্তাহ আগে, ৭ এপ্রিল, দামেস্কের পূর্বাঞ্চলীয় উপশহর দুমায় রাসায়নিক হামলা চালানো হয়। বিদ্রোহীদের দখলে ছিল শহরটি। পশ্চিমা বিশ্বের অভিযোগ, শহরটি পুনর্দখল করতেই আসাদ সরকার সেখানে রাসায়নিক হামলা চালায় এবং এতে আক্রান্ত হয় বেসামরিক নারী, পুরুষ ও শিশুরা। ওই হামলার এক দিন পরই দুমায় থাকা বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এতে করে পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগের ভিত্তি আরও শক্ত হয়।

এরপরই শুরু হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের হামলা চালানোর হুমকি। শেষে শুক্রবার তা বাস্তবে রূপ নেয়। সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, তিনটি দেশই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহার করেছে। লোহিত সাগরে অবস্থান করা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বি-১ ল্যান্সার বোমারু উড়োজাহাজও ব্যবহার করেছে। পেন্টাগনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সিরিয়ার তিনটি স্থানকে লক্ষ্য করে মোট ১০৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে কমপক্ষে ৫৯টি টমাহক মিসাইল। এ ছাড়া বি-১ ল্যান্সার বোমারু উড়োজাহাজ থেকে নিক্ষেপ করা হয় ১৯টি স্ট্যান্ডঅফ মিসাইল।

সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স । ছবি: এএফপি
সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স । ছবি: এএফপি

অন্যদিকে যুক্তরাজ্য টর্নেডো ও টাইফুন যুদ্ধবিমান দিয়ে সিরিয়াতে হামলা চালিয়েছে। সিএনএন জানিয়েছে, মোট আটটি স্টর্ম শ্যাডো নামের ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে যুক্তরাজ্য। আর সিরিয়ায় হামলার ক্ষেত্রে ফ্রান্স ব্যবহার করেছে রাফালে ও মিরেজ যুদ্ধবিমান। নির্ধারিত স্থানে নয়টি স্কাল্প ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে দেশটি।

সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতেই এ হামলা। তবে দুমায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছে সিরিয়া। দেশটির সরকারের দাবি, রাসায়নিক গ্যাস হামলা বিদ্রোহীদের একটি সাজানো ঘটনা। আসাদ সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সও। ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, এরপরও রাসায়নিক হামলা হলে ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।

গত হামলায় কী ফল?
শুক্রবারের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঠিক এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সিরীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত এক বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল। তখন মোট ৫৯টি টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সেটিও করা হয়েছিল রাসায়নিক হামলার প্রত্যুত্তর হিসেবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, গত বছরের এপ্রিল মাসে চালানো হামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতেই এ হামলা। ছবি: এএফপি
সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর ঘোষণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতেই এ হামলা। ছবি: এএফপি

সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত বছরের ওই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের খুব সামান্যই ক্ষতি হয়েছিল। গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় সংঘর্ষ থামাতে তা কোনো ভূমিকা রাখেনি। বন্ধ হয়নি রক্তপাত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক কেভিন ব্যারন বলেন, ‘সেটি কোনো কার্যকর হামলা ছিল না। বিমানবন্দরের একটি রানওয়েকে লক্ষ্য করে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু সিরিয়ার আসাদ সরকার দ্রুতই তা পুনর্নির্মাণ করে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।’

এনবিসি নিউজের খবরে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে চালানো হামলার এক মাসের মধ্যেই হোমস প্রদেশের শেরাত বিমানঘাঁটি পুনর্ব্যবহার করতে শুরু করেছিল আসাদ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করে।

শুক্রবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর ঘোষণা দেওয়ার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, আগের বছরের হামলায় আসাদ সরকারের বিমানবাহিনীর মোট সক্ষমতার ২০ শতাংশ ধ্বংস হয়েছিল। তবে ট্রাম্পের এই দাবির সত্যাসত্য কখনোই নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

সামরিক বিশ্লেষক জেনারেল ব্যারি ম্যাককেফরে এনবিসি নিউজকে বলেন, ‘সিরিয়ার চলমান যুদ্ধে ওই হামলার কোনো প্রভাবই ছিল না। উল্টো তাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সেটি হয়তো বিশ্বের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা ছিল। কিন্তু বেসামরিক মানুষের ওপর রাসায়নিক হামলা বন্ধ হয়নি।’

গত শুক্রবার সিরিয়ার তিনটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। দামেস্কের আকাশে দেখা যাচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র। ছবি: এএফপি
গত শুক্রবার সিরিয়ার তিনটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। দামেস্কের আকাশে দেখা যাচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্র। ছবি: এএফপি

এবার কী অবস্থা?
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কিছুক্ষণ পরই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের কার্যালয় থেকে টুইট করা হয়। প্রথম টুইট বার্তায় লেখা ছিল, ‘সম্মানিত ব্যক্তিকে অপমান করা যায় না।’ এর কয়েক ঘণ্টা পর একটি ভিডিওচিত্র পোস্ট করা হয়। তাতে দেখা গেছে, খুবই স্বাভাবিকভাবে দামেস্কে নিজের কার্যালয়ে ঢুকছেন বাশার আল-আসাদ।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর স্থানীয় বাসিন্দারা দামেস্কের রাস্তায় আসাদ সরকারের সমর্থনে মিছিল করেছে। ওই সময় সাধারণ মানুষের হাতে সিরিয়ার জাতীয় পতাকার সঙ্গে সঙ্গে ছিল ইরান ও রাশিয়ার পতাকাও। এই দুটি দেশই আসাদ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যার জোরেই টিকে আছেন বাশার আল-আসাদ।

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও শোনি ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক আমর আল-আজম বলেন, সিরিয়া ইস্যুতে নিজেদের প্রভাব খাটানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিশ্বশক্তিগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে। এতে সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সিরীয় যুদ্ধে বাশার আল-আসাদ জিতছেন।

অধ্যাপক আমর আল-আজম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সামরিক সামর্থ্য কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অন্যদিকে, এটি আসাদের জন্য অনেক বড় বিজয়। তিনি অবশ্যই একে নিজের জন্য ভালো মনে করছেন। যতটুকু হারিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করেছেন বাশার আল-আসাদ।’

রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি ও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিরিয়ার সক্ষমতা কতটুকু—সেই ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়েছে। এই বিষয়টি পুরোপুরি অভিযোগ ও অস্বীকারের বৃত্তে বন্দী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি, শুক্রবারের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাঁদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। সব ক্ষেপণাস্ত্রই নির্ধারিত স্থানে আঘাত হেনেছে বলে দাবি যুক্তরাষ্ট্রের। তবে আসাদের মিত্রদেশ রাশিয়ার বক্তব্য, অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্রই ভূপাতিত করা হয় এবং ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম।

দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সিরিয়ার যেসব নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন হামলার পক্ষে, তাঁরা দ্রুতই হতাশ হয়ে পড়বেন। কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন, হামলা হবে আরও বড় পরিসরে। আর বিদ্রোহীদের বক্তব্য, এই হামলা আসাদ সরকারকে সামরিক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে উৎসাহ জোগাবে। এতে আরও বেশিসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক পড়বে মৃত্যুঝুঁকিতে।

যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোর আশা, সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে জেনেভার শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি আসবে। কিন্তু তার মধ্য দিয়ে আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হবেন—সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই বলে মন্তব্য করেন এমিল হোকায়েম। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের এই জ্যেষ্ঠ ফেলো বলেন, ‘এর আগেও অনেক খারাপ পরিস্থিতিতে উতরে গেছেন আসাদ। এবারও তা-ই হবে।’