সৌদি আরবে হঠাৎ সিনেমা চালুর সিদ্ধান্ত কেন?

রিয়াদে সিনেমা হলের সামনে পোজ দিচ্ছেন এক নারী। সৌদি আরব, ১৮ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স
রিয়াদে সিনেমা হলের সামনে পোজ দিচ্ছেন এক নারী। সৌদি আরব, ১৮ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স

ভাবছেন ব্যাপারটা কী? ৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে সৌদি আরব কেন হুট করে সিনেমা চালুর সিদ্ধান্ত নিল? 

খবরটায় ইতি-নেতি দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই দেখা গেছে। কেউ বাহবা দিচ্ছে। বলছে, অবশেষে! আর সমালোচকেরা বলছে, গেল গেল!

যেকোনো পরিবর্তনে বাহবার পাশাপাশি নিন্দা লক্ষণীয়। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা আগ্রাসী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া সৌদি আরব বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। তবে দেশটির কর্তৃপক্ষ নিন্দামন্দের পরোয়া না করে সংস্কার প্রশ্নে অটল থাকার ভূমিকা নিয়েছে।

সৌদি আরবে পরিবর্তনের সবশেষ চমক দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার পর গতকাল বুধবার দেশটির রাজধানী রিয়াদে সিনেমার উদ্বোধনী প্রদর্শনী। যেই-সেই সিনেমা নয়, হলিউড ব্লকবাস্টার ‘ব্ল্যাক প্যানথার’। এই প্রদর্শনী শুধু আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের জন্যই ছিল। সর্বসাধারণের জন্য প্রথম সিনেমার পর্দা উঠবে কাল শুক্রবার।

সিনেমা দেখার জন্য টিকিট কিনছেন লোকজন। রিয়াদ, সৌদি আরব, ১৮ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স
সিনেমা দেখার জন্য টিকিট কিনছেন লোকজন। রিয়াদ, সৌদি আরব, ১৮ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যের কট্টর রক্ষণশীল দেশটির হঠাৎ সিনেমার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। তবে সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তের পেছনে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ কাজ করেছে।

লন্ডনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান চ্যাঠাম হাউসের জ্যেষ্ঠ গবেষক জেনি কিনিনমন্ট মনে করেন, সিনেমা চালুর সিদ্ধান্তটি সৌদি আরবের সমাজজুড়ে ব্যাপক পরিবর্তন-প্রক্রিয়ারই একটি অংশ।

গত শতক পর্যন্ত সৌদির ক্ষমতাসীন আল সৌদ পরিবার অনেকটা নিশ্চিন্তেই শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। তাদের মূল ভরসা দেশটির বিপুল তেলসম্পদ। আর রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সৌদি আরবকে এখন একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

রাজার গোলাও একসময় শূন্য হয়ে যায়—সৌদির বর্তমান শাসকদের মধ্যে এই অনুভূতি এখন প্রবল। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, একদিন তেল ফুরিয়ে যাবে। তাই তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প খুঁজতে হবে। তা না হলে খুব বেশি দিন টিকে থাকা যাবে না।

অন্যদিকে, দেশটির শাসকদের ক্ষমতার অন্যতম খুঁটি ধর্মীয় নেতাদের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমছে। তা ছাড়া এই ধর্মীয় নেতারা রাজনৈতিকভাবে রাজপরিবারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন। এসব বিবেচনায় এই গোষ্ঠীটির ক্ষমতা হ্রাসের পক্ষে দেশটির বর্তমান নেতৃত্ব।

সৌদি শাসকদের পরিবর্তনমুখী হতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে দেশটির জনমিতিরও একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সৌদি আরবের জনসংখ্যা তিন কোটির (৩২ মিলিয়ন) কিছু বেশি। জনগণের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। আবার এই তরুণদের বয়স ত্রিশের নিচে।

বিশ্বজুড়ে এখন তরুণদের জয়জয়কার। তাদের অবজ্ঞা করা কোনো শাসকের পক্ষেই সম্ভব না। তরুণদের উপেক্ষার পরিণতিতে মসনদও উল্টে যেতে পারে।

সিনেমা হলে কোমল পানীয় কিনছেন দর্শনার্থীরা। রিয়াদ, সৌদি আরব, ১৮ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স
সিনেমা হলে কোমল পানীয় কিনছেন দর্শনার্থীরা। রিয়াদ, সৌদি আরব, ১৮ এপ্রিল। ছবি: রয়টার্স

সৌদি বাদশা সালমানকে দূরদর্শীই বলতে হয়। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পেরেছেন। তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি তাঁর ৩২ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করেছেন। সিংহাসনের এই উত্তরাধিকারী এখন সৌদির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান সারথি।

আধুনিক চিন্তাচেতনার অধিকারী টগবগে এই যুবরাজের কথা: ‘কঠোরতর পরিশ্রম করো, পদ্ধতির সমালোচনা কোরো না, আর অধিকতর আমোদ করো।’

বোঝাই যাচ্ছে, সৌদি আরবের বর্তমান শাসকেরা তাঁদের ক্ষমতা টেকসই করতে পরিবর্তনকে একটি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কৌশলপূর্ণ এই পরিবর্তন বা সংস্কারের বৃহৎ তিনটি ক্ষেত্র হলো—সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি। এসব ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে এমন কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তনের ঘোষণা এসেছে, যা শুধু সৌদি আরব নয়, সারা বিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

সিনেমার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো অনেকের কাছে বিস্ময়ের। তবে বাস্তবতা হলো, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সৌদি আরবে অনেকটাই অর্থহীন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সিনেমার প্রতি সৌদি জনগণের বিপুল আগ্রহ একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ ব্যাপার। অবস্থা এমন যে দেশের বাইরে গিয়েও অনেকেই সিনেমা দেখে। আবার তথ্যপ্রযুক্তি হাতে থাকলে সিনেমা দেখা ঠেকায় কে!

কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করলে পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়। ২০১৪ সালের এক জরিপ বলছে, সৌদি আরবের দুই-তৃতীয়াংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রত্যেক সপ্তাহে অনলাইনে একটি করে সিনেমা দেখে। আর দেশটির প্রতি ১০ জন নাগরিকের মধ্যে ৯ জনেরই স্মার্টফোন আছে।

দেশটির সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে সৌদি নাগরিকেরা বিনোদন ও আতিথ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যত্র ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। এই অর্থ সৌদি আরবের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ।

বিনোদন ও আতিথ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় প্রবণতায় সৌদি কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তাই তারা দেশের অর্থ দেশে রাখতেই উদ্যোগী হয়েছে।

চলচ্চিত্রশিল্প সৌদি আরবের জন্য অর্থনৈতিকভাবে একটি লাভজনক খাত হতে পারে। এই খাতের বদৌলতে হাজারো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, সিনেমা চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ‘এক ঢিলে তিন পাখি মারা’র আয়োজন সম্পন্ন হলো। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক—তিন দিক দিয়েই সুফল পাওয়ার আশা দেশটির সরকারের।