দিন ভালো যাচ্ছে না যোগী আদিত্যর

বৈদিক সংস্কৃতে ‘যোগী’ শব্দের অর্থ একত্র করা। আর এ কাজ যিনি করেন, তিনি যোগী। এর আধ্যাত্মিক অর্থ হলো ঈশ্বরে লীন হয়ে তাঁর সঙ্গে একাত্ম হওয়া। যোগী আদিত্যনাথ ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এক বছর সময় পার করলেন। ২৪ কোটি মানুষের এই রাজ্য বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জনবহুল অঞ্চল। বহু বৈচিত্র্য, ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের গভীর দ্বন্দ্বে ডুবে থাকা এ রাজ্যে একতার সন্ধান খুব জটিল কাজ, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর এমন জটিল আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এক বছর পার করেছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। লোকসভার উপনির্বাচনে নিজেরটিসহ দুই আসনে হার, উত্তপ্ত হওয়া দলিত আন্দোলন, এনকাউন্টার, অর্থনীতির দুরবস্থা, দলের ভেতরে প্রবল চাপ—সব মিলিয়ে বছর পরের সময়টা ভালো যাচ্ছে না গোরক্ষনাথ মন্দিরের এই যোগীর।


ধর্মীয় নেতা তিনি, তারপরও রাজনীতির জটিল বৃত্তে আগমন কেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মতো এত জাগতিক পথেইবা কেন বিচরণ? আদিত্য বলেন, ‘যখন কোনো রাজা ব্যর্থ হয়, তখন যোগী বা সন্ন্যাসীরাই দায়িত্ব নেন। এর বহু উদাহরণ আছে। বৈরী পরিবেশে তখন যোগী-সন্ন্যাসীরা সুন্দরের পথের সন্ধান দিতে পারে।’

যোগী আদিত্য তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে আরও যুক্তি খাড়া করেন। রাজ্যের দুরবস্থার জন্য আগের শাসকদের দায়ী করেন। বলেন, ‘রাজ্যের এই দুর্গতি কায়েমি স্বার্থের রাজনীতি এবং দুর্বল নেতৃত্বের জন্য। আগের শাসকেরা প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলেছেন। রাজ্যকে একেবারে খাদের প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

২০১৭ সালের মার্চ মাসের নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে এক ভূমিধস বিজয় পায় বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হন চারবারের লোকসভার সদস্য যোগী আদিত্যনাথ। তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটা অনেকের কাছেই ছিল বিস্ময়কর।

এক বছরের অর্জন কী? জবাবে যোগীর উত্তর, ‘মানুষের মনের নেতিবাচক ধারণা পরিবর্তনে আমরা সফল হয়েছি। আগে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল।’

গেরুয়া বসনধারী যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় বেশ সাড়া পড়ে যায়। মোদির মতো হিন্দুত্ববাদী যোগীও ঝড় তুলবেন—এমন আশাই করা হয়েছিল। তবে কয়েক মাস ধরে এ মুখ্যমন্ত্রীর দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। সত্যিই তিনি এক অগ্নিপরীক্ষায় পড়েছেন। হিন্দি বলয়ে কঠোর গেরুয়া মানুষটির ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের শাসক হিসেবে তাঁর সক্ষমতা প্রশ্নের মুখে।

এ কথা ঠিক, ভারতের সবচেয়ে পরিশ্রমী মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে একজন যোগী আদিত্যনাথ। তাঁর ঘুম ভাঙে ভোররাত চারটায়। দিনমান কাজ করে ঘুমোতে যান মধ্যরাতে। তাঁর ব্যক্তিগত সততা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। ভারতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত একটি রাজ্যে তাঁর কাজকর্মে স্বচ্ছতাও আছে।

ক্ষমতায় এসে যোগী আদিত্য সরকারি কাজে ই-টেন্ডারিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। দুস্থ কৃষক, বাজেভাবে বাস্তবায়িত সরকারি কাজে গতি আনা, রাজ্যে বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনার মতো কাজ তিনি করার চেষ্টা করেছেন। এসবের মধ্যে ভুলে যাননি নিজের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করতে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কথা। যেমন গোহত্যায় নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বৃহৎ এই রাজ্যটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আর তাই এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে তিনি ধীরে চলো নীতি নিয়েছেন। বখাটেদের উৎপাত কমাতে ‘অ্যান্টিরোমিও’ কার্যক্রম এবং হিন্দু নারীদের সঙ্গে অন্য ধর্মের পুরুষদের বিয়ে ঠেকাতে কথিত ‘লাভ জিহাদ’ নিয়েও ধীরেসুস্থে চলছেন। গৃহ ও স্যানিটেশন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারে বড় প্রকল্প পেয়েছেন। কৃষিঋণ মওকুফের প্রচেষ্টা আছে তাঁর।

তবে এসব প্রচেষ্টার পরও সুশাসন এ রাজ্যের একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়েই গেছে। মন্ত্রিসভায় যেসব সদস্য আছেন, তাঁরা প্রায় সবাই নতুন। রাজ্যের বিরাট অঙ্কের আর্থিক ঋণ পরিশোধ কীভাবে হবে, সে জন্য একটি রোডম্যাপ আজতক দিতে পারেনি উত্তর প্রদেশের সরকার। উন্নয়ন বাজেটের ৩০ শতাংশ এখন ঋণের দায় মেটাতে চলে যায়। দক্ষিণের রাজ্যগুলোর তুলনায় এ হার দ্বিগুণ।

উত্তর প্রদেশের মতো একটি বড় রাজ্য চালাতে গেলে একজন শক্তিশালী, অভিজ্ঞ নেতার দরকার, যিনি রাজনীতি এবং প্রশাসনের মধ্যে একটি সমন্বয় করতে পারবেন। কিন্তু আদিত্যনাথ বহুমাত্রিক ক্ষমতার বৃত্তে বন্দী। এর মধ্যে আছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, যেটি নিবিড়ভাবে রাজ্যের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। কারণ, ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির ফিরে আসার জন্য এ রাজ্যে দলীয় সরকারের কাজ ভালো হওয়াটা অপরিহার্য বলে মনে করে তারা। আদিত্যকে ঘিরে আছেন দলেন কেন্দ্রীয় সভাপতি অমিত শাহ। তিনি দলের এমপি ও বিধায়কদের সঙ্গে জোটসঙ্গীদের সমন্বয় করেন। আছেন যোগীর দুই উপমুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রশ্নসাপেক্ষ। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের সঙ্গেও তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আছে। আছে এক অনগ্রসর আমলাতন্ত্র। আদিত্যকে ঘিরে থাকা এই জটিল চক্রকে নিয়ে কৌতুক করে রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা রাম গোবিন্দ চৌধুরী বলেন, ‘সমাজবাদী পার্টির সরকারের সময় বিজেপি বলত, রাজ্যে সাড়ে পাঁচ মুখ্যমন্ত্রী আছে। আর এখন বিজেপির সময় মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটে। এর মধ্যে আছেন যোগী নিজে, দুই উপমুখ্যমন্ত্রী, বিজেপির রাজ্য সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিজেপির কেন্দ্রীয় সভাপতি। তিনি রাজ্যের মহামুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন।’

সদ্য সমাপ্ত লোকসভার দুই আসনের পুনর্নির্বাচনে বিজেপির হারের পর আদিত্যর খ্যাতি সত্যিই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে গোরক্ষপুরের আসনটি ছিল যোগী আদিত্যরই। এখান থেকে তিনি টানা পাঁচবার এমপি হয়েছিলেন। গত বছর এটি খালি হয়। আরেকটি আসন ছিল রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্যের। এই বড় পরাজয় যোগী আদিত্যনাথের ব্যক্তিগত পরাজয় শুধু নয়, মাঠের বাস্তবতা সম্পর্কে তিনি যে কতটা অজ্ঞ, তারও প্রমাণ বটে। দুই নির্বাচনের ফলাফল শাসক দলকে বড় বিড়ম্বনায় ফেলেছে। তাদের বড় বিপদ, রাজ্যে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল সমাজবাদী পার্টি (এসপি) এবং বহুজন সমাজবাদী পার্টির (বিএসপি) এক হয়ে যাওয়া। দুই দল এক হয়ে মহাবিজয় ছিনিয়ে আনে। গত বছর বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি উত্তর প্রদেশের ৪০৩ আসনের মধ্যে পায় ৩২৫ আসন। আর ২০১৪ সালের লোকসভার নির্বাচনে রাজ্যের ৮০টি আসনের মধ্যে ৭৩টিই যায় বিজেপির ঝুলিতে। তবে আগামী লোকসভার নির্বাচন এমন সুফল বয়ে যে আনবে না, বর্তমান ফলাফল তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

উত্তর প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দলিত। সম্প্রতি এ রাজ্যে অসন্তোষ দেখা গেছে দলিতদের মধ্যে। বিজেপি বর্ণহিন্দুদের প্রতি ঝুঁকে থাকা দল। তবে গত দুই নির্বাচনে কৌশলে তারা দলিত ভোটকে নিজেদের টিকে টানতে সফল হয়। কিন্তু সম্প্রতি দলিত নেতারাই দলীয় নেতৃত্বের বিমাতাসুলভ আচরণের অভিযোগ এনেছেন। দলিত সম্প্রদায়ের বিজেপি দলীয় এমপি ছোটে লাল খাড়োয়ার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়ে রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জাতপাতের বৈষম্যের অভিযোগ এনেছেন। আরও তিন এমপি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দলিতদের নিগ্রহের অভিযোগ এনেছেন।

আদিত্যনাথ ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি রাজ্যের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তিনি অপরাধীদের প্রতি কঠোর হওয়ার আহ্বান জানান পুলিশকে। অপরাধ দমনে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ফল হলো, গত এক বছরে এনকাউন্টারের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৩২২ জন। অর্থাৎ, প্রতিদিন গড়ে চারজন এনকাউন্টারের শিকার। একাধিক নিরীহ মানুষ এর শিকার বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজ্যের নইদা জেলায় ২৫ বছর বয়সী যুবক জিতেন্দ্র যাদব এদের একজন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি তুচ্ছ এক ঘটনায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশের উপপরিদর্শক বিজয় দর্শন। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা জিতেন্দ্রকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তবে তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।

প্রশাসনের এ ধরনের কাজের পাশাপাশি চলছে বিজেপির দলীয় নেতা-কর্মীদের উগ্রতা, অপরাধ। চলতি মাসের ৮ তারিখে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরী বিজেপির বিধায়ক কুলদীপ সিঙ্গারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনে। মেয়েটি বিচার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। এর পরের দিন মেয়েটির বাবা পুলিশ হেফাজতে মারা যান।

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে কাসগঞ্জ এলাকায় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে গোলযোগের সময় জকেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর জন্য হিন্দুত্ববাদীদের দায়ী করেন। এরপরই তাঁকে সেখান থেকে বদলি করা হয়। এ ছাড়া রাজ্যের মুজাফ্‌ফরনগর ও শামলিতে মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ থাকা ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

এসব ঘটনায় রাজ্যের বিরোধীরাও কিন্তু সরব। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও এসপি নেতা অখিলেশ যাদব বলেছেন, ‘গত এক বছরে বিজেপি সরকার শুধু সেসব কাজেরই উদ্বোধন করেছে, যেগুলো প্রকল্প আমরা নিয়েছিলাম।’
––ইন্ডিয়া টুডে অবলম্বনে