বড় শহরগুলোয় খুনের হার বাড়ছে যে কারণে

বিশৃঙ্খল নগরায়ণ একজন মানুষকে হত্যায় ইন্ধন জোগায় বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। রয়টার্স ফাইল ছবি
বিশৃঙ্খল নগরায়ণ একজন মানুষকে হত্যায় ইন্ধন জোগায় বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। রয়টার্স ফাইল ছবি

রোজ বিশ্বে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। হত্যা, আত্মহত্যা, যুদ্ধ, সড়ক দুর্ঘটনা সব এর আওতায় পড়ে। কিন্তু ঠিক কী কারণে এগুলো ঘটছে? অনেকেই মনে করতে পারেন, এ জন্য দায়ী ‘যুদ্ধ’। কিন্তু নথিভুক্ত পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে সারা বিশ্বে ৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশই ছিল খুন। আর মাত্র ১৮ শতাংশ মারা গেছে যুদ্ধের কারণে। বাকি ১৪ শতাংশ অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ পত্রিকাটিতে বলা হয়নি। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, এগুলোর কারণ আত্মহত্যাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বিশ্বব্যাপী এত খুনের ঘটনা ঘটছে? সমাজবিজ্ঞানে এর একটি কার্যকারণগত আলোচনা মেলে। আর তা হলো নগরায়ণের প্রভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার বাড়ছে।

সাধারণ চিন্তায় এসব খুনের ঘটনা গরিব দেশগুলোয় বেশি ঘটে বলে মনে করা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা পুরোই আলাদা। এগুলো বেশি ঘটছে ধনী দেশগুলোয়। আর এতে এগিয়ে রয়েছে লাতিন আমেরিকা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় বসবাস করে। অথচ ২০১৬ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নথিভুক্ত খুনের ৩৮ শতাংশ ঘটে লাতিন আমেরিকায়। পরিসংখ্যান বলছে, এই অঞ্চলের মোট জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশই ব্যয় হয় অপরাধ দমনে। ইকোনমিস্টের সম্পাদকীয়তে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য ভঙ্গুর সরকারব্যবস্থা, যুদ্ধফেরত যোদ্ধা, বন্দুকধারী, পরিবারের ভাঙন, শহরের ওপর গ্রামীণ সহিংসতা ও দারিদ্র্যের প্রভাব, সংগঠিত মাদক চোরাচালান এবং বড়সংখ্যক বেকারত্বকে দায়ী করা হয়েছে।

এসব হত্যাকাণ্ডের কারণে মা-বাবাকে সন্তানের লাশ বহন করতে হচ্ছে। আবার শিশুদেরও বড় হতে হচ্ছে মা-বাবা ছাড়া। হাজার হাজার নাগরিক তাঁদের পারিবারিক বন্ধন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ ব্যক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে পারিবারিক বন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সমাজবিজ্ঞানীদের সুরে সুর মিলিয়ে ইকোনমিস্টও বলছে, বিশৃঙ্খল নগরায়ণ একজন মানুষকে হত্যায় ইন্ধন জোগায়। কারণ, নগরায়ণ চায় ব্যক্তির ‘দ্রুত আয়’ ও ‘বেশি পুঁজি’। এ দুটোর কোনোটিই সহজে অর্জন করা যায় না। এ জন্য দীর্ঘ সময় ও কঠোর পরিশ্রম দরকার হয়। কিন্তু নগর কাঠামোতে এ দুটো না হলেও চলে যায়। নগরে রয়েছে দ্রুত টাকা বানানোর নানা পথ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোয় নগরকাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ বস্তি, যেখানে চটজলদি টাকা বানানো যায়। বস্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মাদক ও স্মল আর্মসের ব্যবসা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের দিকে তাকালে বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হবে না। ইয়াবা রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় অবধি এর প্রভাব। পত্রিকা খুললে ইয়াবা-সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনার খবরও নিয়মিত মেলে। তবে ঢাকার মতো মেগাসিটিগুলোয় এখন আর বস্তির প্রয়োজন হয় না। অপরিকল্পিত জনাধিক্যের কারণে শহর ও নগরের আকাশছোঁয়া প্রতিটি ভবনকে বস্তির সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে না।

বিশ্বের অনেক দরিদ্র শহরে খুন যেন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আগামী দশকগুলোয় এ ধরনের শহরের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এইচএসবিসি ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে গরিব দেশগুলোয় ৯০ শতাংশ নগরায়ণ বৃদ্ধি পাবে। জনবহুল এমন ৫০টি শহরের মধ্যে ৪২টিই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করবে। আড়াই কোটির মতো করে জনসংখ্যার বাস ঢাকা, করাচি ও নাইজেরিয়ার সাবেক রাজধানী লেগোসে। এই কাতারে আরও শহর যোগ হতে যাচ্ছে। অথচ শহরগুলো তুলনামূলকভাবে ছোট। একটি শহর হুট করেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারে না। এর অভ্যন্তরেও পুঁজিপতি শ্রেণির বিকাশ ঘটতে হয়।

ইকোনমিস্টের দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ খুনের ঘটনা ঘটে লাতিন আমেরিকার ৭টি দেশে। এখানকার খুনগুলোর অন্যতম কারণ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে এল সালভাদরে। এল সালভাদর হলো এ অঞ্চলের মাদক প্রবেশের দরজা। দেশটি ১৯৯২ সাল থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। ২০১৫ সালে সিরিয়ার পর এল সালভাদরেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সহিংস মৃত্যু ঘটনা ঘটেছে। সেখানকার পুলিশ এখন পর্যন্ত বুঝতে পারছে না এমন খুনের পেছনে কারা এবং কী দায়ী। এল সালভাদরের ৯৫ শতাংশ খুনের কিনারা করা সম্ভব হয়নি। সেখানকার পুলিশ বারবার বস্তি ও পাহাড়ি এলাকাগুলোয় অপরাধীদের কাছে হার মানছে। এর পরেই আছে কলম্বিয়া। এর বিভিন্ন শহরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে হত্যাকাণ্ড। কলম্বিয়ার ক্যালি শহরের মেয়র হত্যাকাণ্ডকে সেখানকার একটি ‘রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

নিউইয়র্কের ‘ভায়োলেন্স অবজারভেটরি’ তাদের পর্যবেক্ষণে দেখেছে অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটে মাতলামি আর ঝগড়া থেকে। সংস্থাটি মনে করছে, অ্যালকোহল ও ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর বিধি আরোপ করলে ৩৫ শতাংশ হত্যাকাণ্ড কমে আসবে।

সুইজারল্যান্ডের গবেষণা সংস্থা স্মল আর্ম সার্ভের মতে, যদি বিশ্বের সব কটি দেশ খুনের হার কমাতে পারে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। অন্যথায় এই সময়ে মধ্যে অতিরিক্ত ১২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটবে।

বর্তমান বিশ্বে মানুষের সংখ্যা ৭৫০ কোটির বেশি (৭.৬ বিলিয়ন)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বিদ্যুৎমন্ত্রী শঙ্কর সেন তাঁর এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, মানববসতির শুরু থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার বছরে মাত্র ৩ শতাংশ নগরায়ণ হয়েছে। এক শতাব্দী পরে, অর্থাৎ ১৯ শতকে বিশ্বে নগরায়ণের হার দাঁড়ায় ১৪ শতাংশে। অথচ ২০০৮ সালে জাতিসংঘের হিসাব মতে, বিশ্বের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ গ্রাম ছেড়ে নগরে বাস করছে। ২০৫০ সালের এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৭০ শতাংশে।

ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকায় শহর ও নগরের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পাবে। এখানেও বাংলাদেশকে নিয়ে শঙ্কার কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী একদিকে মিয়ানমার আর অন্যদিকে ভারত। ইতিমধ্যেই দেশ দুটি থেকে ইয়াবা ও ফেনসিডিল প্রবেশ করছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ দ্রুত হারে বাড়ছে শহর ও নগরায়ণ। গ্রামের মানুষজন স্থায়ী-অস্থায়ীভাবে শহর-নগরমুখী হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

২০১৭ সালে জাতিসংঘের দেওয়া প্রতিবেদন মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৯২০ কোটি। যার মধ্যে ৬২০ কোটিই নগরায়ণের আওতায় চলে আসবে। ইকোনমিস্ট বলছে, এই সময়ে এসব শহর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করবে।

মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য কাঠামোগত পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। এ জন্য কৃষিশিল্পকে উৎসাহিত করা যেতে পারে, যাতে মানুষকে তাদের পুরুষানুক্রমিক জীবিকা হারিয়ে ছিন্নমূল হয়ে পথে নামতে না হয়। এমনিতেই বাংলাদেশের সমাজদেহে ঘুণ ধরেছে। যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে অবস্থা এমন হতে পারে, যখন কোনো পদক্ষেপেই হয়তো কাজ হবে না। এমন একটা পরিস্থিতি কারও কাম্য হতে পারে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন সামাজিক আলোচনা, সদুপদেশ ও রাষ্ট্রীয় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগ।

দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে মো. ছানাউল্লাহ