১৯৪৮ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো অভিবাসীরা পাচ্ছেন ব্রিটিশ নাগরিকত্ব

১৯৪৮ সালের ২২ জুন যুক্তরাজ্যের এসেক্সের টিলবারি ডকে নোঙর করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা ‘এমভি এম্পায়ার ইউন্ডরাশ’। ছবি: সংগৃহীত
১৯৪৮ সালের ২২ জুন যুক্তরাজ্যের এসেক্সের টিলবারি ডকে নোঙর করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা ‘এমভি এম্পায়ার ইউন্ডরাশ’। ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল সময়ে (উইন্ডরাশ জেনারেশন হিসেবে পরিচিত) যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো সব অভিবাসীকে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে থেরেসা মের সরকার। বিতর্কিত অভিবাসননীতির কারণে তুমুল সমালোচনার শিকার হয়ে গত সোমবার সরকার এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই সময়ে যুক্তরাজ্যে কর্মজীবন কাটিয়ে যাঁরা নিজ দেশে ফেরত গেছেন, তাঁরাও চাইলে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে আবার আসতে পারবেন। এ জন্য ইংরেজি দক্ষতা যাচাই পরীক্ষা বা আবেদন ফি—কিছুই দিতে হবে না। সরকারের অভিবাসন বিভাগের গঠিত বিশেষ দল এ বিষয়ে আবেদনকারীদের সাহায্য করবে।

উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারি নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন দাবি তুলেছেন, যুক্তরাজ্যে ন্যূনতম ১০ বছর ধরে বসবাস করছেন—এমন অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দিতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি এ প্রস্তাব তোলেন। বরিস জনসন বলেন, অভিবাসন বিতর্কের সমাধানে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার পরিধি আরও ব্যাপক হওয়া উচিত।

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে যেসব অভিবাসী যুক্তরাজ্যে আসেন, তাঁরাই মূলত ‘উইন্ডরাশ জেনারেশন’ হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৮ সালের ২২ জুন যুক্তরাজ্যের এসেক্সের টিলবারি ডকে ‘এমভি এম্পায়ার ইউন্ডরাশ’ নামে একটি জাহাজ নোঙর করে। এ জাহাজে করে ৪৯২ জন অভিবাসী এসেছিলেন। যাঁদের মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু-কিশোর।

শুধু ক্যারিবিয়ান অঞ্চল নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যে শ্রমিক-সংকট মোকাবিলায় কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন তখন যুক্তরাজ্যে আসেন। সে সময় তাঁদের আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজপত্রের প্রয়োজন হতো না। ১৯৭১ সালে অভিবাসন আইন প্রণয়নের পর ওই সুযোগ বন্ধ হয়।

বিবিসিতে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো থেকে ৫৭ হাজার অভিবাসীর আগমন ঘটে। যার মধ্যে ছিল ১৫ হাজার জ্যামাইকান এবং ১৩ হাজার ভারতীয়। বাকি ২৯ হাজার অভিবাসী এসেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান (বাংলাদেশসহ), কেনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।

দশকের পর দশক ধরে এসব অভিবাসী যুক্তরাজ্যের বৈধ নাগরিক হিসেবে বসবাস এবং সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিলেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ সরকার ২০১২ সালে অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাজ্য থেকে বিতাড়নের লক্ষ্যে অভিবাসন আইনে নজিরবিহীন কড়াকড়ি আরোপ করে। ওই আইনে বাড়িভাড়া, ব্যাংক হিসাব খোলা, চিকিৎসা ও সরকারি সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে অভিবাসনের বৈধতা যাচাই বাধ্যতামূলক করে। ফলে যাঁরা কখনো যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্বের আবেদন করেননি কিংবা বৈধতার কোনো কাগজপত্র রাখার প্রয়োজনবোধ করেননি, তাঁরা মহা বিপাকে পড়েন। অভিবাসন বিভাগে প্রতিকার চাইতে গিয়েও পাননি, কারণ তাঁরা যুক্তরাজ্যে আগমনের কোনো বৈধ প্রমাণ দেখাতে পারছেন না। অভিবাসন বিভাগ অনেককে যুক্তরাজ্য থেকে বিতাড়নের হুমকি দিয়ে চিঠি দেয়। ভুক্তভোগী এসব মানুষের মধ্যে অনেক বাংলাদেশিও রয়েছেন।

কয়েক বছর যাবৎ এসব অভিবাসী নিজেদের অধিকারের পক্ষে আন্দোলন করছেন। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। গত সপ্তাহে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলন নিয়ে এ বিতর্ক জোরালো হয়। শেষ পর্যন্ত কমনওয়েলথ সম্মেলনে এসব অভিবাসীর ভোগান্তির জন্য ক্ষমা চান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে।

সর্বশেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাম্বার রাড গত সোমবার জানান, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে আসা সবাই ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাবেন। হোম অফিসের (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বিশেষ দল সম্পূর্ণ বিনা খরচে কাজটি করে দেবে। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে আসা অভিবাসীদের যাঁরা বৈধতা নিয়ে সমস্যায় আছেন, তাঁদেরও ওই সংশ্লিষ্ট দলের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

অ্যাম্বার রাড বলেন, কমনওয়েলথ থেকে আসা উইন্ডরাশ প্রজন্ম যুক্তরাজ্যকে যুদ্ধের ধকল থেকে তুলে দাঁড় করিয়েছে। তাদের অবদান বিশাল। তিনি বলেন, ওই প্রজন্মের যাঁরা যুক্তরাজ্যে কর্মজীবন শেষে নিজ দেশে ফিরে গেছেন, তাঁরাও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন। এ বিষয়ে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর হাইকমিশনের সঙ্গে শিগগিরই কাজ শুরু করবে সরকার।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন ১০ বছরের বেশি সময় অবস্থান করা অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটির পক্ষে মন্ত্রিসভায় জোরালো অবস্থান রয়েছে। ২০০৮ সালে বরিস জনসন যখন লন্ডন মেয়র ছিলেন, তখন তিনি প্রথম এ প্রস্তাব দেন। এরপর ২০১৬ সালে তিনি একই দাবি তোলেন। তবে এবার তাঁর দাবির অন্য রকম তাৎপর্য রয়েছে। কেননা তিনি এখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। অন্যদিকে বিতর্কিত অভিবাসননীতি নিয়ে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি তুমুল সমালোচনার শিকার। যার অনেকটা দায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের। কারণ, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে থেরেসা মে কোনো সমালোচনার তোয়াক্কা না করে অভিবাসনে একের পর এক কড়াকড়ি আরোপ করেন। ঘোষণা দিয়ে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য ‘বিরূপ পরিস্থিতি’ তৈরির মিশন বাস্তবায়ন করেছিলেন তিনি।