প্রথা ভাঙার এক রাজকীয় বিয়ে

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে আসেন প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল। গতকাল যুক্তরাজ্যের উইন্ডসরে।  ছবি: রয়টার্স
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে আসেন প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল। গতকাল যুক্তরাজ্যের উইন্ডসরে। ছবি: রয়টার্স
>
  • বিয়ের অনুষ্ঠানে আধুনিকতা আর রাজপরিবারের ঐতিহ্যের মিশেল।
  • ২০১৬ সালে হ্যারির সঙ্গে পরিচয় মেগানের।
  • গত বছরের নভেম্বরে এই জুটির বাগদানের ঘোষণা আসে।

‘ভালোয় বা মন্দে, প্রাচুর্যে কিংবা দারিদ্র্যে, সুখে-দুঃখে, ভালোবেসে আমরা আমৃত্যু পাশে থাকব।’ ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ এই শপথবাক্য পাঠ করানোর পর স্মিত হেসে বর প্রিন্স হ্যারি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি থাকব।’ হাসিমুখে একই শপথবাক্য পাঠ করলেন কনে মেগান মার্কেলও। তবে স্বামীর শতভাগ বাধ্য থাকার শপথ নিলেন না তিনি। রাজপরিবারের প্রথা ভেঙে প্রিন্স হ্যারিও পরে নিলেন বিয়ের আংটি। তাঁর আগে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কোনো পুরুষ বিয়ের আংটি ধারণ করেননি।

এরপর যুক্তরাজ্যের ৩৩ বছর বয়সী প্রিন্স হ্যারি আর ৩৬ বছর বয়সী মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেলকে দম্পতি ঘোষণা করলেন ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং উপস্থিত ৬০০ অতিথির উপস্থিতিতে পরস্পরকে চুমু খেলেন হ্যারি-মেগান। হর্ষধ্বনিতে ভরে উঠল যুক্তরাজ্যের উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জেস চ্যাপেল। গতকাল শনিবার বিয়ের অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল আধুনিকতা আর রাজপরিবারের ঐতিহ্যবাহী প্রথার মিশেল। হাজার বছরের পুরোনো ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে হলিউডের জৌলুশ মিলেমিশে যেন একাকার।

শ্বেতাঙ্গ বাবা আর কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান মেগান। তাঁর রাজবধূ হওয়ার এই বিয়েকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল অনেক। প্রিন্সেস ডায়ানার ছেলে প্রিন্স হ্যারি। সাত বছর আগে তাঁর ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ে নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ দেখা যায়নি।

উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে হ্যারি-মেগানের বিয়ের সাক্ষী হতে চ্যাপেলের বাইরে জড়ো হন হাজারো মানুষ। আর বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের চোখ আটকে ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য সরকার সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়।

বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। আমন্ত্রণ পাননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তবে মার্কিন তারকা উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রে, সংগীতশিল্পী এলটন জন, সাবেক ব্রিটিশ ফুটবলার ডেভিড বেকহাম ও তাঁর স্ত্রী ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম, হলিউড তারকা জর্জ ক্লুনি ও তাঁর স্ত্রী আমাল ক্লুনিসহ বেশ কয়েকজন তারকা বিয়ের অনুষ্ঠানে আলো ছড়িয়েছেন। বলিউড তারকাদের মধ্যে মেগানের বন্ধু হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া।

বিয়ের মূল অনুষ্ঠানটি শুরু হয় স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার কয়েক মিনিট পর। এর কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল বাকিংহাম প্যালেসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিয়ের পর প্রিন্স হ্যারি ডিউক অব সাসেক্স হিসেবে পরিচিত হবেন। আর রাজপরিবারের নতুন সদস্য মেগানের পরিচয় হবে ডাচেস অব সাসেক্স।

হোটেল থেকে রোলস রয়েস ফ্যান্টম গাড়িতে চেপে দুপুর ১২টার দিকে চ্যাপেলের সামনে হাজির হন সফেদ পোশাকে মোড়ানো কনে মেগান। তাঁর এই পোশাকের নকশা করেছেন ব্রিটিশ ডিজাইনার ক্লেয়ার ওয়েইট কেলার। আর টায়রাটা ছিল হীরকখচিত। সিঁড়ি ভেঙে মেগান একাই চ্যাপেলের ফটক পর্যন্ত উঠে যান। এরপর প্রবেশ দরজা থেকে তাঁর হাত ধরে বেদির দিকে এগিয়ে নেন প্রিন্স হ্যারির বাবা ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস। হোটেল থেকে মেগানের সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলে পৌঁছানোর সময়টায় ১৫ মিনিট উইন্ডসরের ওপর দিয়ে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ রাখে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর।

দুপাশে অতিথিদের সারি পেরিয়ে মেগানকে নিয়ে প্রিন্স চার্লস যখন মূল বেদিতে পৌঁছালেন, স্মিত হেসে প্রিন্স হ্যারি তাঁর বাবাকে ধন্যবাদ জানালেন। হ্যারির চেহারায় আনন্দ আর স্নায়বিক চাপের মিশ্র ছাপ স্পষ্ট। তবে মেগানকে যে সুন্দর লাগছে, তা বলতে ভুললেন না। মেগানের মা ৬১ বছর বয়সী ডোরিয়া রাগল্যান্ডের চোখে তখন আনন্দাশ্রু। এরপর গির্জার গায়ক দল গেয়ে উঠল মার্কিন সংগীতশিল্পী বেন ই কিংয়ের ষাটের দশকের জনপ্রিয় গান ‘স্ট্যান্ড বাই মি’।

ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের সঙ্গে প্রিন্স হ্যারি বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌঁছান স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। এর মিনিটখানেক পরই পৌঁছান মেগানের মা ডোরিয়া। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেননি তাঁর বাবা টমাস মার্কেল। বিয়ের অনুষ্ঠানে রাজপরিবারের ছোট্ট সদস্য চার বছর বয়সী প্রিন্স জর্জ, তিন বছর বয়সী প্রিন্সেস শার্লটসহ ১০ জন ছিলেন কনের সহচর।

বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে চ্যাপেলে পৌঁছান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। অনুষ্ঠানে রানির স্বামী প্রিন্স ফিলিপও উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বেলা ১১টা পর্যন্ত রাজপরিবারের সদস্য নন এমন অতিথিদের চ্যাপেলে প্রবেশের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল। বিয়েতে আড়াই হাজারেরও বেশি লোক উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া রাজপরিবারের ৫৩০ জন কর্মী এবং স্থানীয় বিদ্যালয়ের ১০০ শিশু-কিশোরও ছিল। চ্যাপেলে রাজপরিবারের সদস্যদের প্রবেশ শুরু হয় বেলা ১১টা ২৫ মিনিট থেকে।

নবদম্পতির বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার একটা পর্যায়ে দেওয়া বক্তব্যে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ বিশপ মাইকেল ব্রুস কারি আবেগঘন কণ্ঠে মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মার্টিন লুথার কিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশে বলেন, ‘ভালোবাসায় শক্তি আছে। একে অবমূল্যায়ন করবেন না। জীবনে যে প্রেমে পড়েছেন, তিনিই জানেন আমি কী বোঝাতে চেয়েছি।’

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে আসেন নবদম্পতি। সড়কের দুপাশে তখন অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষের উল্লাস। নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানান তাঁরা। বিকেলে উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জেস হলে অনুষ্ঠিত হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। এতে নতুন ডাচেস অব সাসেক্স মেগান এবং ডিউক অব সাসেক্স প্রিন্স হ্যারি বক্তব্য দেন। প্রিন্স অব ওয়েলশ চার্লসও বক্তব্য দেন। প্রিন্স হ্যারির বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়াম বক্তব্য না দিলেও অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন তিনিই। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অতিথিদের যে খাবার দেওয়া হয়, তাতেও ছিল রাজপরিবারের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সংমিশ্রণ।

দুই বছর আগে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এক অনুষ্ঠানে প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে পরিচয় হয় মেগান মার্কেলের। সেই দেখাতেই প্রেম। গত বছরের নভেম্বরে এই জুটির বাগদানের ঘোষণা আসে ব্রিটিশ রাজপরিবারের পক্ষ থেকে।