মমতা: স্বতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রের পথে?

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জী


বদলে গেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান। ২০১১ সালের ২০ মে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। রাজ্যের মানুষ ভাবেননি, সাত বছরে এতটাই পাল্টে যাবেন, বদলে যাবেন মমতা।

২০১১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দুহাত ভরে ভোট দিয়েছিলেন মমতাকে। বিপুল ভোটে জিতেছিলেন তিনি। হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অবসান ঘটিয়েছিলেন ৩৪ বছরের বাম জমানার। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। দাঁড়িয়েছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষে। সেই মমতা স্বতন্ত্র বোধ থেকে, গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা থেকে সরে এসেছেন স্বৈরতন্ত্রের চিন্তাচেতনার পক্ষে। তাই তো মমতার অনেক ভক্তই এবার বলতে শুরু করেছেন, সেই মমতা আর এখন নেই, বদলে গেছেন, এসেছেন নতুন মমতা। ক্ষমতায় টিকে থাকার অভিপ্রায়ে এসেছেন নতুনরূপে।

পশ্চিমবঙ্গে সদ্য শেষ হওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরই মমতার এই পাল্টে যাওয়ার চিত্র বেশি চোখে পড়ছে। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে এর আগেও পশ্চিমবঙ্গে হাঙ্গামা কম হয়নি। কিন্তু ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা লড়াইয়ে জেতা, বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেওয়া, মারপিট, হত্যা—এসব একেবারে নতুন। আর নতুন ভোটের দিন এত মানুষের প্রাণহানির ঘটনা। আগের এক ব্যতিক্রমধর্মী ‘স্বতন্ত্র’ চিন্তাচেতনার নেত্রী মমতা এমনটা বদলে গেলেন কেন?

২০১১ সাল আগ পর্যন্ত মমতা ছিলেন বিরোধীদের প্রধান কণ্ঠ। আন্দোলনের প্রধান মুখ। সিপিএমের ক্যাডারদের ‘হার্মাদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। চরম আন্দোলন শুরু করেছিলেন টাটার গাড়ি কারখানার জন্য বামফ্রন্টের লিজ দেওয়া প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। আন্দোলন ছড়িয়েছিল হুগলির সিঙ্গুর থেকে কলকাতা, তারপর রাজ্যব্যাপী। সেই আন্দোলনও একসময়ে ছড়িয়েও পড়ে গোটা দেশে। আন্দোলন করেছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও। সিঙ্গুরে তিনি একটানা ২৫ দিনের অনশনও করেছিলেন। কলকাতার ধর্মতলায় মঞ্চ বানিয়ে যোগ দিয়েছিলেন সিঙ্গুর আর টাটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে। রাজ্যব্যাপী হরতাল, বন্‌ধ্‌, সড়ক, রেল অবরোধ—কোনোটাই বাদ দেননি। নিহত ব্যক্তির লাশ নিয়ে মিছিলও করেছেন মমতা। সাড়াও পেয়েছিলেন তিনি প্রচুর। দিকে দিকে মমতার আন্দোলন বেগবান হওয়ায় ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে মমতা রাজ্যপাট থেকে বিদায় করে দেন বামফ্রন্টকে। গড়েন জনগণের সরকার। প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়ে শপথ নিয়ে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন প্রথম পা রাখেন রাজ্য সচিবালয় রাইটার্স ভবনে। ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি জনগণের সেবার জন্য এসেছেন। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এসেছেন। জনগণের কল্যাণের জন্যই তিনি কাজ করবেন। হয়েছিলেন সেদিন তিনি জনগণের মুখ্যমন্ত্রী।

তবে ‘ক্ষমতার লোভ’ স্বতন্ত্র বোধ থেকে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের জন্ম দিয়েছে মমতার মধ্যে। ক্ষমতায় তাঁকে টিকে থাকতে হবে—এই মানসিকতায় মমতা এখন নতুনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন এই রাজ্যপাটে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার লোভ তাঁকে আরও স্বৈরতান্ত্রিক করে তুলেছে মমতাকে। তাই তো তিনি এবং তাঁর দলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কেরা পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে এই রাজ্যপাট থেকে বিদায় করে দেওয়া হবে বিরোধীদের। ১০০ শতাংশ আসনে জয়ী হবে তাঁর দল।

সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আদাজল খেয়ে নামেন দলের নেতা-কর্মীরা। মমতার সেই ঘোষণার সফল রূপ দেন বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। ওই জেলার জেলা পরিষদের আসন রয়েছে ৪২টি। জেলা পরিষদের এই ৪২ আসনের প্রার্থীরাও নির্বাচিত হন ওই জেলার ভোটারদের মাধ্যমে। সেই জেলা পরিষদের আসনে বিরোধীদের কোনো মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়নি তৃণমূল। তবুও ফাঁকফোকর দিয়ে বিজেপি-সমর্থিত এক নারী প্রার্থী একটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে সমর্থ হন। ফলে দেখা যায়, ৪১ আসনের তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যান। বাকি যে একটি আসনে বিজেপির এক নারী প্রার্থী ছিলেন, সেই আসনটিও তৃণমূল প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করে। ফলে, জেলা পরিষদের ৪২টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় তৃণমূল। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৮ হাজার ৬৫০, পঞ্চায়েত সমিতির ৯ হাজার ২১৭ এবং জেলা পরিষদের ৮২৫টি আসনের ৩২ শতাংশও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যান তৃণমূল প্রার্থীরা। রাজ্যব্যাপী বিরোধী দলকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধাদান ও সন্ত্রাসী তাণ্ডবের কারণে বিরোধী দল প্রার্থিতা দিতে না পারায় ৩৪ শতাংশ আসনে জিতে যান মমতা। যদিও এই ৩৪ শতাংশ জয়ী প্রার্থীদের ওপর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক স্থগিতাদেশ জারি করে বলেছেন, আগামী ৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী শুনানির পরই এব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। ফলে, পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় ৬৬ শতাংশ আসনে। আর এই নির্বাচনের ফলে রাজ্যের ২০টি জেলার মধ্যে ১১টি জেলা পরিষদই বিরোধীশূন্য হয়ে পড়ে।

তাই মমতা পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন। শুধু জেলা পরিষদই নয়, থানা পর্যায়ের পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পর্যায়ের গ্রাম পঞ্চায়েতেও বিরোধীশূন্য হয়ে পড়েছে বহু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি।

মমতার এই যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের উদ্‌গ্রীবতা প্রকারান্তরে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রাজ্যের গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার মূল্যবোধে। অথচ এটা চাননি এই রাজ্যের মমতা-ভক্তদের অনেকেই। তাঁদেরই একজন কবি শঙ্খ ঘোষ। পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনিয়ম দেখে তিনি লিখেছিলেন ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ শীর্ষক কবিতা। কবিতার লাইন কয়েকটি এমন, ‘যথার্থ এই বীরভূমি/ উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে/ পেয়েছি শেষ তীরভূমি/ দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাজ্যজুড়ে খড়গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’

এই কবিতার পর মমতা-ঘনিষ্ঠ অনুব্রত মণ্ডল রীতিমতো গালিগালাজ করেন এই কবি শঙ্খ ঘোষকে। অথচ এই কবি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সময় তখনকার শাসক দলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিলেন।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে মমতা তাঁর রাজ্য শাসনের সাত বছরের মাথায় যে দৃষ্টান্ত রাখলেন, তা ভালোভাবে নেননি শঙ্খ ঘোষের মতো রাজ্যের সুধী সমাজ, বিশিষ্টজনেরা। তাই ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘পরিবর্তন চাই’ দাবি নিয়ে যেসব বুদ্ধিজীবী রাস্তায় নেমেছিলেন, রাজ্যব্যাপী বামফ্রন্টের ‘অপশাসনের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, সেই সব বুদ্ধিজীবী এবং বিশিষ্টজনের একাংশ ইতিমধ্যে মমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাঁর সমালোচনা শুরু করেছে।

এ কথা ঠিক, মমতা এই রাজ্যের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। উন্নয়ন ঘটেছে গ্রামেগঞ্জে। তাই তো তাঁর দলের লোকজনের মুখে একটি কথা ছিল, এবার পঞ্চায়েতে মমতার উন্নয়নের বহর দেখে মানুষ ভোট দেবে তাঁকে দুহাত ভরে। আর এটাও ঠিক, এখনো গ্রামাঞ্চলে মমতার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাহলে মমতা বিনা ভোটে জয়ের জন্য এই কৌশল কেন নিলেন? এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজ্যব্যাপী। সে বিরোধী শিবির হোক বা শাসক দলের শিবিরেও। মমতার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার এই উগ্র বাসনার যে নেতিবাচক দিক আছে, তাও ফুটে উঠতে পারে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে। কারণ, পঞ্চায়েত নির্বাচন রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত হয়। আর লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে।

প্রশ্ন হলো, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের এত উগ্র বাসনা থাকবে কেন এই ‘ত্যাগী নেত্রী’ মমতার? কেন তিনি তাঁর নিজস্ব স্বতন্ত্র বোধ থেকে ঘুরে যাবেন স্বৈরতন্ত্রে? বিসর্জন দেবেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে। তবে কি বিজেপি-ভূত মমতাকে তাড়া করেছে? কারণ, বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে। সিপিএম চলে গেছে তৃতীয় স্থানে।