পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গল মহলে বিজেপির উত্থান, শঙ্কিত তৃণমূল

জঙ্গল মহল। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
জঙ্গল মহল। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি


পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেশির ভাগ আসনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হলেও হাতছাড়া হয়েছে জঙ্গল মহল। এটাই এখন তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গল মহলে বিজেপির উত্থানে শঙ্কিত দলটি।

নির্বাচনে এত বুথ দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে ভোট ছিনিয়ে নেওয়া, জাল ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরা, নির্বাচনে সন্ত্রাস করা—এমন অনেক অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এরপরও কেন বিজেপি এই জঙ্গল মহলে এত আসন পেল? তবে কি জঙ্গল মহলে আবার মাওবাদীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে? মাওবাদীরা কি আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের মূল কারিগর? তারা কি নিয়ন্ত্রণ করছে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ? নানা প্রশ্নে জেরবার তৃণমূল।

এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৯০ শতাংশ আসনে জয়ী হয়ে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এক নতুন ইতিহাস গড়েছে। দ্বিতীয় ইতিহাস গড়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৩৪ শতাংশ আসনে জিতে। তৃণমূল রাজ্যের ২০টি জেলার অধিকাংশ এলাকায় জয়ের ঝান্ডা তুলেছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম হচ্ছে জঙ্গল মহল।

পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গল মহলে বিরোধী দল বিজেপি ও স্থানীয় আদিবাসীদের দল ভালো ফল করেছে। এই ফলাফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে শাসক দলের মধ্যে। কারণ, এই জঙ্গল মহল মাওবাদীদের এলাকা হিসেবে পরিচিত। আর এই বিস্তৃত জঙ্গল মহল রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া জেলার জঙ্গলজুড়ে।

এই জঙ্গল মহলের সীমান্তরেখায় রয়েছে মাওবাদী-অধ্যুষিত ঝাড়খন্ড রাজ্য। অনেক দিন ধরেই জঙ্গল মহল ছিল মাওবাদীদের দখলে। আর এই এলাকায় মাওবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল বাম শাসনের শেষ দিকে। তখন মাওবাদীরা এতই তৎপর ছিল যে তৎকালীন রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না মাওবাদীদের। মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় নেতা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেনজি আস্তানা গেড়ে ছিলেন এই জঙ্গল মহলে। এখানে টেন্ডুপাতার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মাওবাদী নেতা ছত্রধর মাহাত বিদ্রোহ করেছিলেন বাম শাসনের বিরুদ্ধে।

সেদিন পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের প্রধান নেতা ছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা মাওবাদীদের মন বুঝে এগিয়ে আসেন। দাঁড়ান তাদের পাশে। তৃণমূল ক্ষমতায় এলে তিনি মাওবাদীদের সমস্যার সমাধান করবেন, দাবি মেনে নেবেন বলে ঘোষণা দেন। মমতার ডাকে সাড়াও দেন মাওবাদীরা। এমনকি ২০১১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে মাওবাদীরা জঙ্গল মহলে মমতার তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার ঘোষণা দেয়। মাওবাদী নেতা ছত্রধর মাহাতও এসে দাঁড়ান মমতার পাশে। ওই সময় ছত্রধর মাহাতসহ জঙ্গল মহলের বহু নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়ী হয়। ক্ষমতায় আসেন মমতা। হন মুখ্যমন্ত্রী। এরপরই মমতা মাওবাদীদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ডাক দেন। এতে বেশ কিছু মাওবাদী আত্মসমর্পণ করে রাজ্য সরকার ঘোষিত পুনর্বাসন কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে মাওবাদী সংসর্গ ছাড়ে।

কিন্তু মমতা ক্ষমতায় আসার পর কারাবন্দী মাওবাদীদের অধিকাংশের আর মুক্তি হয়নি। এ নিয়ে ফের ক্ষোভ ছড়াতে থাকে মাওবাদীদের মধ্যে। মমতা ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের নভেম্বরে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা কিষেনজিকে জঙ্গল মহলে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মাওবাদীরা। তবু দীর্ঘদিন ধরে চুপ থাকা মাওবাদীরা আবার নতুন করে তৎপরতা শুরু করে জঙ্গল মহলে। ভেতরে-ভেতরে সংঘবদ্ধও হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা মমতার বিরুদ্ধে ক্ষোভও প্রকাশ করে। মাওবাদীরা তাদের কারাবন্দী নেতাদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায়। এতে সাড়া দেননি মমতা। আর এই সুযোগে বিজেপি এসে দাঁড়ায় মাওবাদীদের পাশে।

এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গল মহলের আদিবাসী সম্প্রদায় আর তেমনভাবে মমতার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তারা এবার স্থানীয় দল, নির্দল ও বিজেপির পাশে দাঁড়ায়। ফলাফলে দেখা যায়, এসব অঞ্চলে কার্যত সরকার বিরোধীরা, বিশেষ করে বিজেপি এবং স্থানীয় আদিবাসীদের দল ভালো ফল করেছে।

এই ফলাফলে শাসক দলের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। তবে কি মাওবাদীরা ফের ভেতরে-ভেতরে সংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন নামে নির্বাচনে নেমেছে? আগে মাওবাদী-অধ্যুষিত ঝাড়গ্রাম ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। এখন ঝাড়গ্রাম নতুন একটি জেলা হয়েছে। এখানেই একসময় বেশি তৎপর ছিল মাওবাদীরা। মাওবাদীদের আঁতুড়ঘর ছিল এই ঝাড়গ্রামের তুলা ভেদা অঞ্চল। এবার এই তুলা ভেদা গ্রাম পঞ্চায়েতের ১১টি আসনের মধ্যে একটি আসনও পায়নি তৃণমূল। বিজেপি পেয়েছে ছয়টি। আর আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ পেয়েছে পাঁচটি আসন। আবার বাঁশ পাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০টির মধ্যে সাতটি পেয়েছে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ। একটি পেয়েছে বিজেপি। আর শিমুলপাল পঞ্চায়েতে ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ ও বিজেপি তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে।

তৃণমূলের জয়ের জোয়ারের মধ্যে এই মাওবাদী-অধ্যুষিত জঙ্গল মহলে বিজেপি ভালো ফল করেছে। ঝাড়গ্রামে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮০৬টি আসনের মধ্যে ৩২৮টি আসন পেয়েছে বিজেপি, পশ্চিম মেদিনীপুরের ১ হাজার ৫৪৯টি পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৪১৭টি আসন, বাঁকুড়ার ২ হাজার ৫০৫টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ২৩৪টি আসন এবং পুরুলিয়ায় ১ হাজার ৯৪৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৬৪৪টি আসন।