অর্থের বিনিময়ে 'হিন্দুত্ববাদী' খবর প্রচার করতে রাজি হয়েছিল ২৫টি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম!

ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে কাঁপিয়ে দিয়েছে কোবরাপোস্ট নামের একটি ওয়েবসাইট। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, পুষ্প শর্মা নামের একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ভারতীয় বড় বড় সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। কোবরাপোস্টের চালানো স্টিং অপারেশনে দেখা গেছে, অর্থের বিনিময়ে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির ‘হিন্দুত্ববাদী’ খবর প্রচার করতে রাজি হয়েছিল দেশটির প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যম। এই খবর ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশেরও আগ্রহ দেখায়নি এসব মিডিয়া। এ নিয়ে এখন টালমাটাল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে চলছে ভারতীয় মিডিয়া? আর বস্তুনিষ্ঠতা ও সত্য প্রকাশে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বই বা কোথায় গেল?

গত শুক্রবার ৪৯টি ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে কোবরাপোস্ট দাবি করেছে, অর্থের বিনিময়ে বিজেপির ‘হিন্দুত্ববাদী’ খবর প্রচার করতে রাজি হয়েছিল দেশটির ২৫টি সংবাদমাধ্যম। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়েছে, এক সপ্তাহ আগে প্রথম দফায় কিছু ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে কোবরাপোস্ট। ১৭টি মিডিয়াগোষ্ঠীর ওপর ওই ভিডিওগুলো তৈরি করা হয়েছিল। এরপর শুক্রবার ফের কিছু ভিডিওচিত্র প্রকাশ করা হয়। মূলত, ভারতের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে কথা বলার ভিডিওচিত্র এগুলো। এতে দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ কর্তারা অর্থের বিনিময়ে ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাজনীতির খবর প্রচারে রাজি হয়ে যান। একই সঙ্গে বিজেপির পক্ষ নিয়ে কংগ্রেস, বহুজন সমাজবাদী পার্টি (বিএসপি), সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ও জনতা দলের (ধর্মনিরপেক্ষ) নেতাদের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশের বিষয়েও রাজি হয়েছিলেন এসব সংবাদমাধ্যমের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।

প্রকাশিত ভিডিওতে নেটওয়ার্কএইটিন, স্টার ইন্ডিয়া, জি নিউজ, টাইমস গ্রুপ (টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ একাধিক পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের মালিক), ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপ, দৈনিক জাগরণ, হিন্দুস্তান টাইমস, পেটিএমসহ বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ কর্তাদের দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়াগোষ্ঠীর মালিক বা সম্পাদকদেরও ভিডিওতে দেখা গেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের ভাইস চেয়ারপারসন কাল্লি পুরি, টাইমস গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিনীত জৈন, পেটিএমের ভাইস প্রেসিডেন্ট অজয় শেখর শর্মা, ভারত সমাচারের প্রধান সম্পাদক ব্রিজেশ মিশ্র প্রমুখ। কোবরাপোস্ট মোট ২৭টি সংবাদমাধ্যমে স্টিং অপারেশন চালিয়েছিল। এর মধ্যে সাজানো প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করেছে দুটি বাংলা পত্রিকা। এগুলো হলো কলকাতার দৈনিক বর্তমান ও সংবাদ।

শুক্রবার ভিডিওগুলো প্রকাশের আগের দিনই দিল্লি হাইকোর্ট একটি ভিডিওর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। দৈনিক ভাস্করের পক্ষ থেকে করা নিষেধাজ্ঞার আবেদনে সাড়া দিয়ে গত বৃহস্পতিবার আদালত বলেছিলেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট ভিডিও প্রকাশ করা যাবে না। আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোবরাপোস্ট তাদের পূর্বনির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন বাতিল করে এবং বাকি সব ভিডিওচিত্র অনলাইনে প্রকাশ করে দেয়। এই ডকুমেন্টারির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ১৩৬: পার্ট ২’। এর শুরুতেই বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক ২০১৭ সালের সূচকে ভারতের অবস্থান দেখানো হয়।

পুষ্প শর্মাই মূলত স্টিং অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। ছদ্মবেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে গিয়ে শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে অর্থের বিনিময়ে হিন্দুত্ববাদী খবর প্রচারের প্রস্তাব দেন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে দেওয়া প্রস্তাবে হিন্দুত্ববাদী খবর প্রচারের জন্য দেড় কোটি রুপি থেকে দরদাম শুরু করেন পুষ্প। অন্যদিকে, স্টার ইন্ডিয়া ও টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের মতো জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকে ৫০০ কোটি রুপি পর্যন্ত দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। তবে এসব ভিডিওচিত্রে নগদ বা চেকে অর্থ লেনদেন বা চুক্তি স্বাক্ষরের কোনো বিষয় চোখে পড়েনি।

>

স্টিং অপারেশন কী?
সত্য উদ্‌ঘাটনের জন্য সাংবাদিকেরা ছদ্মবেশে যে অভিযান চালান, তাকেই বলা হয় স্টিং অপারেশন। এ ক্ষেত্রে অংশ নেওয়া সাংবাদিক নিজের পরিচয় গোপন করে একটি ফাঁদ পাতেন এবং তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে প্রকৃত সত্য বের করে আনার চেষ্টা করেন। তবে এসব স্টিং অপারেশনের নৈতিক ভিত্তি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই এ ধরনের অভিযানকে নৈতিকতাবিরোধী বলে অভিহিত করে থাকেন। অন্যদিকে, স্টিং অপারেশনের পক্ষের ব্যক্তিদের বক্তব্য, প্রকৃত সত্য বের করতেই এ ধরনের অভিযান প্রয়োজন।

ভিডিওচিত্রে কে কী বলেছেন
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘শ্রীমদ্‌ভগবতগীতা প্রচার সমিতি’র আচার্য সেজে সংবাদমাধ্যমগুলোর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন পুষ্প শর্মা। অর্থের বিনিময়ে মোট তিনটি পর্বে প্রচার চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। প্রথম পর্বে বলা হয়, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্যতম অবতার কৃষ্ণর বিভিন্ন উক্তি এবং হিন্দুত্ববাদী বক্তব্য প্রচারের শীর্ষে রাখতে হবে। দ্বিতীয় পর্বে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রচারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন পুষ্প। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘পাপ্পু’, ‘বুয়া’, ‘বাবুয়া’ প্রভৃতি নামে অভিহিত করে অপমান করার কথা বলেন আচার্যরূপী পুষ্প। এর বিপরীতে ‘হিন্দু নেতাদের’ পক্ষে ইতিবাচক সংবাদ প্রচারের প্রস্তাব দেন তিনি। তৃতীয় পর্বে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। পুষ্প বলেছিলেন, নির্বাচনের মাঠকে ‘বিভক্ত’ ও ‘সাম্প্রদায়িক’ রূপ দেওয়ার জন্য উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচার করতে হবে।

প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের কাল্লি পুরি বলছেন, ‘...যেকোনো ধরনের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আমরা কোনো বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দিই না। আমাদের নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেকোনো বিজ্ঞাপন এখানে চালানো যেতে পারে।’ তবে ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের সম্পাদকীয় নীতিমালায় কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। তবে কথিত ওই বিজ্ঞাপন ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের কার্যালয়ে তৈরির বিষয়ে রাজি হয়েছিলেন কাল্লি পুরি।

কোবরাপোস্টের ভিডিও অনলাইনে প্রকাশের পর এক বিবৃতিতে ইন্ডিয়া টুডে বলেছে, যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, তা এই ভিডিওচিত্রে প্রকৃতভাবে দেখানো হয়নি এবং সত্যকে বিকৃত করা হয়েছে।

অন্যদিকে, প্রকাশিত ভিডিওতে টাইমস অব ইন্ডিয়া গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিনীত জৈনকে নগদে ৫০০ কোটি রুপি দেওয়ার প্রস্তাব করেন পুষ্প শর্মা। তাঁদের মধ্যে অর্থ লেনদেনের পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হতে দেখা গেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বিনীত জৈন ও তাঁর একজন সহযোগী অর্থ চেকে দেওয়ার অনুরোধ করছেন। তবে বিনীত বলেন, তারা এই কাজ করতে রাজি, তবে নিজেদের নিরপেক্ষ রূপ ধরে রাখতে হবে। ভিডিওতে বিনীতকে বলতে দেখা গেছে, ‘করপোরেট হিসেবে আমাদের নিজেদের নিরপেক্ষ প্রতীয়মান করতে হবে। যতটুকু নিরপেক্ষ থাকা যায় আরকি...।’

তবে ভিডিওচিত্র প্রকাশের পর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বিনীত জৈন। সানডে এক্সপ্রেসের পক্ষ থেকে তাঁকে ই-মেইল করা হলেও তিনি তার কোনো উত্তর দেননি।

কোবরাপোস্টের প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, পুষ্প শর্মার প্রস্তাবে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা অনিল দুয়া বলছেন, ‘প্রথম দুটি ধাপ সম্ভব। দেখুন, আপনি যেভাবে চাইছেন, সেভাবে কাজ করতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’ এরপরই সংবাদমাধ্যমের সিইওর সঙ্গে কথা বলার শর্ত দেন অনিল। তিনি বলেন, সিইওর সঙ্গে কথা বলা ছাড়া কিছু করা যাবে না।

কোবরাপোস্টের ভিডিও প্রকাশের পর অনিল দুয়া দ্য সানডে এক্সপ্রেসের কাছে দাবি করেন যে তাঁর বক্তব্য পুরোপুরি প্রচারিত হয়নি এবং সম্পাদনা করা হয়েছে।

অন্যদিকে, পেটিএমের কাছেও আচার্য হয়ে গিয়েছিলেন পুষ্প শর্মা। প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি শীর্ষ কর্মকর্তা অজয় শেখর শর্মা বলছেন, এরই মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) হয়ে অনেক কাজ করেছেন তারা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী অফিসের কাছে গ্রাহকদের তথ্য দেওয়ার কথাও স্বীকার করেন অজয়। ভিডিও প্রকাশের পর এক টুইট বার্তায় অবশ্য পেটিএম দাবি করেছে, ভিডিওতে যা দেখানো হয়েছে, তা সর্বৈব মিথ্যা। গ্রাহকদের সব তথ্য নিরাপদেই আছে।

নিখাদ ‘ফাঁদ’
কোবরাপোস্টের অনিরুদ্ধ বহাল দ্য সানডে এক্সপ্রেসকে বলেছেন, পুষ্প শর্মা নিজেই এই অনুসন্ধান চালিয়েছেন। কোবরাপোস্ট শুধু পুষ্পর কাছ থেকে প্রতিবেদনগুলো কিনেছে। অনিরুদ্ধ বলেন, ‘প্রতিবেদক একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁরা এটিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন...তাঁদের কেউ (মিডিয়া নির্বাহী) একবারও চিন্তা করেননি যে আমাদের কাছে অর্থ না-ও থাকতে পারে।’

অনিরুদ্ধ জানান, কোনো অর্থই ছিল না প্রতিবেদকের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কীভাবে অর্থ দেব? আমাদের কোনো অর্থই নেই।’ অর্থাৎ পুষ্প শর্মা শুধু অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। আর তাতেই ধরা ভারতীয় মিডিয়ার শীর্ষ ব্যক্তিরা।

কে এই পুষ্প শর্মা?
টাইম মিডিয়া গ্রুপের মালিকানাধীন অন্যতম সংবাদমাধ্যম হলো টাইমস অব ইন্ডিয়া। কোবরাপোস্টের ভিডিওগুলো প্রকাশের পর এই সংবাদমাধ্যম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে দিল্লি পুলিশ পুষ্প শর্মাকে গ্রেপ্তার করেছিল।

ভারত সরকারের আয়ুশ মন্ত্রণালয়ে যোগব্যায়ামের প্রশিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিমদের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য করা হচ্ছে—এমন একটি প্রতিবেদন ২০১৬ সালে প্রকাশ করেছিলেন পুষ্প। তাতে বলা হয়েছিল, যোগব্যায়ামের প্রশিক্ষক পদে মুসলিমদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। তবে সরকার পক্ষের অভিযোগ ছিল, তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া একটি সরকারি জবাব নকল করেছিলেন পুষ্প। তবে পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারণ, পুষ্পর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

টাইমস অব ইন্ডিয়া আরও দাবি করেছে, ২০০৯ সালেও নাকি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল পুষ্প শর্মাকে। তখন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্ঘটনা সাজিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে স্টিং অপারেশন চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল।