বিশ্বকাপে নারী সাংবাদিকদের যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছেই

পর্তুগিজ চ্যানেল টিভি গ্লোবো ও স্পোর্টটিভির সাংবাদিক জুলিয়া গুইমার। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া
পর্তুগিজ চ্যানেল টিভি গ্লোবো ও স্পোর্টটিভির সাংবাদিক জুলিয়া গুইমার। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

রাশিয়ায় ফুটবলের সবচেয়ে জমকালো আসর বিশ্বকাপে এবার নারী সাংবাদিকদের যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের খবর সংগ্রহের সময় সাংবাদিক গঞ্জালেসের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা আলোচিত হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল, সেখানে এমনটি আর ঘটবে না। তবে কয়েকটি ঘটনা প্রমাণ দিচ্ছে, বিশ্বজুড়ে হ্যাশট্যাগ দিয়ে ‘মি টু’ আন্দোলন দিয়ে নারীরা যত সোচ্চারই হন না কেন, যৌন হেনস্তাকারীদের তা স্পর্শ করে না।
সরাসরি সম্প্রচার চলার সময় হয়রানির শিকার গঞ্জালেস তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি সামলে নিয়ে তাঁর কাজ শেষ করেন। দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ওই হেনস্তাকারীকে আর খুঁজে পাননি। তবে জুলিয়া গুইমার নামের আরেক নারী সাংবাদিককে সম্প্রচার চলার সময়েই হেনস্তাকারীকে প্রতিরোধ করতে দেখা গেছে।

সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, এবার বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত কয়েক সপ্তাহে যৌন হয়রানি, হেনস্তা ও অনলাইনে বিদ্রূপাত্মক আচরণের শিকার হয়েছেন নারীরা। শুধু ক্যামেরার সামনে নয়, পেছনে কাজ করছেন—এমন নারীরাও হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। জার্মানির টেলিভিশন চ্যানেল জেডডিএফের এক নারী ধারাভাষ্যকার বিশ্বকাপে তাঁর ভাষ্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করে নজির স্থাপন করেছে ওই চ্যানেল।

বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক সংগঠন ফিফার তথ্য অনুসারে, রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলের খবর সংগ্রহ করছেন বিভিন্ন দেশের ১৬ হাজার সাংবাদিক। এর মাত্র ১৪ শতাংশ নারী।

সরাসরি সম্প্রচারে জুলিয়াকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন এই লোক। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া
সরাসরি সম্প্রচারে জুলিয়াকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন এই লোক। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

প্রতিবেদনে যৌন হয়রানির শিকার নারী সাংবাদিকদের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, গঞ্জালেসের ঘটনাটি এবার বিশ্বকাপে নারী সাংবাদিকদের হয়রানির শিকার হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়।

হুলিয়েত গঞ্জালেস থেরান ১৫ জুন রাশিয়ার সারানস্ক শহর থেকে জার্মান সম্প্রচার মাধ্যমে ডয়চে ভেলের স্প্যানিশ সংবাদ চ্যানেলের জন্য খবর সংগ্রহ করছিলেন। সরাসরি সম্প্রচার চলার সময় এক দর্শক দ্রুত এসে তাঁকে চুমু খেয়ে চলে যান। ওই সময় গঞ্জালেস একবারের জন্যও সম্প্রচার না থামিয়ে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান। এ ঘটনা তাঁকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে জানিয়ে পরে ডয়চে ভেলেকে গঞ্জালেস জানান, সরাসরি সম্প্রচারের জন্য তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ঘটনাস্থলে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এ সময় তিনি কোনো সমস্যায় পড়েননি। যখনই সরাসরি সম্প্রচারের কাজ শুরু হয়, তখনই পরিস্থিতির সুযোগ নেন যৌন হয়রানিকারী। কাজ শেষ হওয়ার পর ওই ব্যক্তিকে তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেও পাননি।

যৌন নিগ্রহের এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে দেওয়ার পর নারী সাংবাদিকদের প্রতি আরও শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করার আহ্বান জানান গঞ্জালেজ থেরান। তাঁকে হয়রানি করা ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়নি।

বিশ্বকাপ ফুটবলের সরাসরি সম্প্রচারে খবর পাঠানোর সময় সাংবাদিক হুলিয়েত গঞ্জালেস থেরানের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা আলোচিত হয় বিশ্বব্যাপী। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
বিশ্বকাপ ফুটবলের সরাসরি সম্প্রচারে খবর পাঠানোর সময় সাংবাদিক হুলিয়েত গঞ্জালেস থেরানের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা আলোচিত হয় বিশ্বব্যাপী। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

পর্তুগিজ চ্যানেল টিভি গ্লোবো ও স্পোর্টটিভির সাংবাদিক জুলিয়া গুইমার রাশিয়ার ইয়েকাতেরিনবার্গ থেকে সরাসরি সম্প্রচারে খবর পাঠাচ্ছিলেন। ওই সময় এক লোক ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করলে তিনি খবর পাঠানো থামিয়ে কাত হয়ে ওই লোককে প্রতিহত করেন এবং শাসান। ওই সময় ওই লোক দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।

ওই ঘটনার পর গ্লোবো এসপোর্টে নামক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুলিয়া বলেন, ‘এটা ভয়াবহ। আমি ওই সময় খুব অসহায় ও বিপন্ন বোধ করছিলাম। ওই সময় আমি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম। তবে আমার খারাপ লাগে, লোকজন এটা বোঝে না। তারা কেন ভাবে যে এই ধরনের আচরণ করার তাদের অধিকার আছে।’

এ নিয়ে জুলিয়া টুইটারে লিখেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভাগ্য ভালো যে ব্রাজিলে আমি এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হইনি। আর এখানে (রাশিয়া) দুবার এমন ঘটনা ঘটল। দুঃখজনক! লজ্জাকর!’

গুইমারের মতো সুইডিশ নারী সাংবাদিক মালিন ওয়াহ্লবার্গ একই ঘটনার শিকার হয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়া ও সুইডেনের ম্যাচ চলার সময় সংবাদ পাঠানোর সময় তাঁকে এক ব্যক্তি জড়িয়ে ধরে চুমু খান।

আর্জেন্টাইন ইএসপিএনের প্রতিবেদক আগোস লারোকা এবং ফ্রান্স ২৪-এর কেথেভান গরজেসতানি নামের দুই নারী সাংবাদিকও হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এসব ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করে ফিফার ফার্স্ট সেক্রেটারি ফাতমা সামোউরা টুইটারে লিখেছেন, ‘রাশিয়ায় অনেক নারী তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন পেশাদারি আচরণের মাধ্যমে। তাঁদের প্রতি এবং তাঁদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো জরুরি।’

ব্রাজিলের আরেক নারী সাংবাদিক আমান্ডা কেসতেলমান রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলের খবর সংগ্রহ করছেন। তাঁর সহকর্মীদের এমন হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘২০১৪ সালে রাশিয়ায় শীতকালীন অলিম্পিকে আমি এসেছিলাম। কিন্তু এবার বিশ্বকাপ ঘিরে হেনস্তার যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, তা ওই সময় দেখিনি। ফুটবল-সমর্থকেরা হয়তো মনে করছেন, এটা শুধু পুরুষদের জন্য আয়োজন।’ তিনি জানান, রাস্তায় চলাচলের সময় ফুটবল-ভক্ত ও মাতাল লোকজনের কারণেও অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।

আমান্ডা বলেন, ‘আমি একবার মেট্রো থেকে নেমে এক ছেলেকে আমার সঙ্গে হেঁটে যেতে অনুরোধ জানাই। কারণ, একদল ছেলে ট্রেনে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছিল।’

ব্রাজিলের আরেক নারী সাংবাদিক লুইজা অলিভেরিয়া জানান, তিনি নিজে শিকার না হলেও যৌন হয়রানি প্রত্যক্ষ করেছেন। সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘আমি দোভাষী হিসেবে রাশিয়ার এক মেয়েকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। ফিফা ফ্যান জোনে রাশিয়ার মেয়েটিকে নিয়ে কাজ করার সময় অন্তত পাঁচজন পুরুষ তাঁর সঙ্গ পেতে চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ তাঁকে স্পর্শও করে। একদিন রেড স্কয়ারে এক ব্যক্তি অনুমতি ছাড়াই তাঁকে জড়িয়ে ধরে সেলফি তোলেন। আমি ওই লোককে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি তা করতে পারেন না, এটা অসম্মানজনক। ওই লোক তখন বলেন, এটা তাঁর স্ত্রীর জন্য তুলেছেন। যেন স্ত্রীর কথা বললেই এমন কিছু করা জায়েজ হয়ে যায়।’

সাংবাদিক লুইজা অলিভেরিয়া জানান, তিনি নিজে শিকার না হলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে যৌন হয়রানি প্রত্যক্ষ করেছেন। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া
সাংবাদিক লুইজা অলিভেরিয়া জানান, তিনি নিজে শিকার না হলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে যৌন হয়রানি প্রত্যক্ষ করেছেন। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

যুক্তরাজ্যের ভিকি স্পার্কস বিশ্বকাপের প্রথম নারী ভাষ্যকার হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন, তিনিও বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন। পর্তুগাল মরক্কোর বিরুদ্ধে খেলায় জয় পাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠস্বরের সমালোচনা করেন অনেকে। চেলসিয়া ও টটেনহামের সাবেক খেলোয়াড় জেসন ভিক্টর কান্ডিও যোগ দিয়েছিলেন এ দলে। টুইটারে বলেন, ‘তাঁর ধারাভাষ্য শোনা কঠিন ছিল। আমি পুরুষ কণ্ঠই শুনতে চাইছিলাম। উচ্চকণ্ঠে তাঁর ৯০ মিনিটের ধারাবর্ণনা শুনতে চাইছিলাম না।’

পরে অবশ্য তিনি এ ব্যাপারে ক্ষমা চেয়ে টুইটারে লেখেন, ‘কখনো সময় আসে দুই হাত ওপরে তুলে স্বীকার করা যে ভুল হয়েছে এবং নিজেকে নির্বোধ বলা। এখন সেই সময় এসেছে। একজন নারী ভাষ্যকারকে খাটো করে মন্তব্য করার কোনো জায়গা নেই বলে আমি বুঝতে পেরেছি। সে জন্য আমি সত্যিকারভাবে দুঃখিত।’

এদিকে জার্মানির জেডডিএফ তাদের ধারাভাষ্যকার ক্লদিয়া নিউমানকে অনলাইনে হেনস্তাকারী দুজনের বিরুদ্ধে দেশটির আদালতে মামলা করেছে।

জার্মান সংবাদপত্র জেইটে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্লদিয়া বলেন, ‘কিছু লোক ভদ্রতার সবকিছু হারিয়ে ফেলে।’