দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীদের সঙ্গী তৈরি ও সন্তান ধারণে অনীহা

দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক নারী এখন বিয়ে করতে চাইছেন না। বিয়ে করলেও তাঁরা সন্তান নিতে অনিচ্ছুক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক নারী এখন বিয়ে করতে চাইছেন না। বিয়ে করলেও তাঁরা সন্তান নিতে অনিচ্ছুক। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

চই মুন জিয়ং। সিউলের পশ্চিমাঞ্চলের এক শহরতলির বাসিন্দা। একটি বড় প্রতিষ্ঠানে কর হিসাবরক্ষক হিসেবে বেশ সুনাম তাঁর। কাজের দক্ষতার কারণে বসের কাছেও প্রিয়। একদিন তাঁর জীবনে এল আকাঙ্ক্ষিত দিন। জানতে পারলেন, তিনি মা হতে চলেছেন। সেই আনন্দের খবরটি বসকে জানানোর পর যে প্রতিক্রিয়া পেলেন, তাতে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। বস তাঁকে বললেন, ‘তোমার সন্তান হলে তো সেই তোমার কাছে সবচেয়ে প্রাধান্য পাবে। আর প্রতিষ্ঠান থাকবে দ্বিতীয় তালিকায়। তাহলে তুমি কি কাজ করতে পারবে?’ শুধু একবার নয়, বিভিন্নভাবে তিনি বারবার একই কথা শুনিয়েছেন।

শুধু যে বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন, তা নয়। প্রতিদিন মুন জিয়ংয়ের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হতো। অযথাই চিৎকার–চেঁচামেচি করতেন। এ নিয়ে অফিসে অভিযোগ করা হলে উল্টো বস আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে বসেন, ‘কাজে মনোযোগ নেই মুন জিয়ংয়ের।’ এত দিন যাঁর কাজের জন্য এত প্রশংসা করা হতো, আচমকা তিনি চোখের বালি হয়ে গেলেন।

মুন জিয়ং বিবিসিকে বলেন, ‘এত অশান্তি আর আমি নিতে পারছিলাম না। একদিন আমার শরীর কাঁপতে থাকত। চোখ খুলতে পারছিলাম না। আমার সহকর্মীরা চিকিৎসক ডেকে নিয়ে আসেন। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। চিকিৎসক বলেছেন, অতিরিক্ত চাপের কারণে এসব হচ্ছে। এ থেকে আমার গর্ভপাত হতে পারে।’ তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সন্তানটি। এক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে কাজে ফিরে তিনি বুঝতে পারেন, বস চাইছিলেন, তিনি যেন স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। মুন জিয়ংয়ের মতো এ অভিজ্ঞতা দেশটিতে খুব অস্বাভাবিক নয়।

বিয়ে করলে গৃহস্থালি কাজ সামলানোর দায়িত্ব ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, ঘরের বউকেই নিতে হয়। এরপর সন্তান হলে সেই দায়িত্ব চিরায়ত রূপে মায়ের কাঁধেই পড়ে। আর সেই মা যদি চাকরিজীবী হন, তাহলে মাথার ওপর ঝুলতে থাকে চাকরি চলে যাওয়ার ভয়। কিন্তু চাকরিটা তাঁর নিজের পাশাপাশি সন্তানের জন্যই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। কারণ, সন্তানের পড়াশোনার ব্যয় বিশাল ব্যাপার। সেখানে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা বিনা বেতনে থাকার পরও স্কুলে ব্যাপক প্রতিযোগিতা। ফলে অভিভাবকদের গুনতে হয় অতিরিক্ত টিউশন ফি।

আর এমন বাস্তবতায় দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক নারী এখন বিয়ে করতে চাইছেন না। কিংবা বিয়ে করলেও সন্তান নিতে অনিচ্ছুক।

এই নারী সন্তানের দেখভালের জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ২০১৫ সালে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিডিও থেকে ছবিটি নেওয়া।
এই নারী সন্তানের দেখভালের জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ২০১৫ সালে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিডিও থেকে ছবিটি নেওয়া।

দেশটিতে প্রতি এক হাজারে মাত্র ৫ দশমিক ৫ জন বিয়ে করেন। অথচ ১৯৭০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯ দশমিক ২।

সন্তান জন্ম দিতে দেশটির নারীদের যে অনীহা রয়েছে, সেটা জন্মহারেই স্পষ্ট। বিশ্বে জন্মহার সবচেয়ে কম দক্ষিণ কোরিয়ায়। বিশ্বব্যাংক বলছে, সিঙ্গাপুর, হংকং ও মলদোভার মতো দক্ষিণ কোরিয়ায়ও জন্মহার কম। দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা ধরে রাখতে যেখানে জন্মহার প্রয়োজন প্রায় ২ দশমিক ১, সেখানে এখন এই হার ১ দশমিক ২। আবার রাজধানী সিউলে তা শূন্য দশমিক ৮৪।

কঠোর পরিশ্রম, অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করা ও কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ—দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের এসব গুণ দেশটির ৫০ বছরের মধ্যে উন্নয়শীল দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশে পরিণত হতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তবে এই কর্মযজ্ঞে নারীরও যে ভূমিকা ছিল, তা অবলীলায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নারীর অবদান উপেক্ষিত হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার এই অর্থনৈতিক সফলতা কম মজুরিপ্রাপ্ত কারখানাশ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। এসব কারখানার বেশির ভাগ কর্মীই নারী। এর বাইরে দেশটিতে পরিবারের কাজ মানেই তা নারীদের, এমন ভাবনার প্রবণতা রয়েছে। ধরে নেওয়া হয়, পরিবারের সদস্যদের যত্নআত্তি সব করবে নারীরা। আর পুরুষেরা করবে বাইরের কাজ।

তবে শুধু পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে থেকে পিছিয়ে থাকতে রাজি নন নারীরা। আগে ব্যবস্থাপনা ও বিশেষায়িত কাজগুলো ছিল ছেলেদের দখলে। এখন মেয়েরাও সেসব কর্মস্থলে সমানে টেক্কা দিচ্ছেন। ওয়েব কমিক আর্টিস্ট ২৪ বছরের তরুণী ঝাং ইয়ন হা বিবিসিকে বলেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরও লৈঙ্গিক বৈষম্য দূরীকরণে কোথায় যেন বাধা। এখানে নারীদের শুধু পুরুষের ভোগ্যসামগ্রী হিসেবে মনে করা হয়। ভাবা হয়, বিবাহিত নারীরা কেবল পরিবারের দেখাশোনা করবেন। সন্তান হলে দেখভালও করবেন মা। এমনকি শ্বশুর-শাশুড়ি অসুস্থ হলে তাঁদেরও সেবা করার দায়িত্ব পালন করতে হয় বাড়ির বউকে।

অর্থনৈতিক সহায়তা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইডিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার পুরুষেরা শিশুর যত্নসহ বেতনবিহীন শ্রমে দিনে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় ব্যয় করেন। সেখানে একজন নারীকে ব্যয় করতে হয় এর পাঁচ গুণ সময়।

সিউলের একটি এনজিওতে কর্মরত এক নারী বলেন, ‘বিয়ের অর্থই যেন পুরুষটি আশা করে, তুমি (স্ত্রী) বাসায় থাকবে এবং তাঁর (স্বামী) জন্য রান্নাবান্না করবে। কেন আমি তা করতে চাইব?’

২০১৪ সালে সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে সাড়ে ২২ শতাংশ নারী বিয়ে, সন্তানের জন্ম ও সন্তানের দেখভালের জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। রয়টার্সের ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি
২০১৪ সালে সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে সাড়ে ২২ শতাংশ নারী বিয়ে, সন্তানের জন্ম ও সন্তানের দেখভালের জন্য চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। রয়টার্সের ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি

সমাজের এত সব বৈষম্যের কারণে দেশটির নারীরা বিয়ে করতে চান না, সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু সঙ্গীতেও কেন অনীহা? অনেক নারী পুরুষের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলতেও নারাজ। কারণ খুঁজতেই জানা গেল, প্রেমিকের কিছু ভয়ংকর আচরণ নারীদের পুরুষ সঙ্গীর ব্যাপারে বিমুখ করে তুলছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেমিকদের প্রতিশোধপরায়ণতা বড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন হলে প্রেমিকার অনুমতি না নিয়েই প্রেমিক দুজনের রোমান্টিক ছবি, অডিও বা ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন, যা ‘রিভেঞ্জ পর্ন’ নামে পরিচিত।

গত বছর কোরিয়ান ইনস্টিটিউট অব ক্রিমিনোলজি প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ পুরুষ তাঁর নারী সঙ্গীর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে প্রতারণা করেছে।

এসব জেনেশুনে ইয়ন ঝাং ইয়ন হা নামের এক তরুণী বিয়ের কথা মাথায় আনতে চান না। তিনি মনে করেন, নিজের একা জীবন নিয়ে বেশ ভালো আছেন। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চান তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে দেশটিতে নারীরা হলেন ‘দাসী’।

তবে সঙ্গী তৈরি ও সন্তান ধারণে নারীর এই অনীহা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে যাচ্ছে দেশটিতে। আর সেটা বুঝেই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অফিসের কর্মীদের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ৬৮ ঘণ্টার পরিবর্তে করা হয়েছে ৫২ ঘণ্টা। স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া, অবসাদ কাটানো ও জন্মহার বাড়ানোর জন্য নতুন এ নিয়ম জারি করেছে দেশটি। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে নিয়মটি চালু হয়েছে। দেশটির পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী চুয়াং হুন দক্ষিণ কোরিয়ার কম জন্মহারের জন্য নারীদের অতিরিক্ত কাজ করাকে দায়ী করেছেন।

তবে সরকারের এসব পদক্ষেপ সমস্যার কতটুকু সমাধান করতে পারবে, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। নারীরা সন্তান নিতে চাইলে যাতে কোনোভাবে বৈষম্যের শিকার না হন, এমন আইন আছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। সবকিছু মিলিয়ে দেশটিতে নতুন এক সামাজিক প্রপঞ্চ তৈরি হয়েছে, যার নাম ‘শ্যাম্পু’ প্রজন্ম। এখানে শ্যাম্পু মানে সম্পর্ক, বিয়ে ও সন্তান—এ তিন থেকে নিজেকে গুটিয়ে পরিষ্কার রাখা।

এই প্রজন্মের মানসিকতাকে আগের প্রজন্মের মায়েরা স্বার্থপরতা বলেই মনে করছেন। ষাটোর্ধ্ব এক নারী জানান, তাঁর তিন মেয়ে। অথচ মেয়েদের কোনো সন্তান নেই। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে দেশাত্মবোধ দেখিয়েছি। আমি চাই, আমার সন্তানেরাও তা করুক। কিন্তু তারা মনে হয় তেমনটা চায় না।’

তিন সন্তানের মা এই বৃদ্ধার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে হতাশা প্রকাশ করেন আরেক বৃদ্ধা। তিনি বলেন, ‘আজকালকার মেয়েদের দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকা উচিত। জন্মহার এতটা কম যে আমরা এ নিয়ে খুবই চিন্তিত। এভাবে সন্তানের সংখ্যা কমতে থাকলে একসময় তো এই দেশের সংস্কৃতি মরে যাবে।’

তবে উল্টোভাবে ‘শ্যাম্পু’ প্রজন্মের নারীদের সাফ জবাব, ‘আগে পুরুষ শাসিত সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে।’