এবার কী বলবে রাশিয়া?

সাবেক গোয়েন্দা সেরগেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়া
সাবেক গোয়েন্দা সেরগেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়া

যুক্তরাজ্যে আশ্রিত সাবেক রুশ গোয়েন্দা সেরগেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়া স্কিপালকে হত্যার উদ্দেশে বিষ প্রয়োগের ঘটনায় তুলকালাম কম হয়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই বিষ রাশিয়ার গবেষণাগারে তৈরি সামরিক কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিক ‘নোভিচক’ বলে চিহ্নিত করে যুক্তরাজ্য। গত মার্চ মাসের ওই ঘটনায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সরাসরি রাশিয়াকে দায়ী করে। রাশিয়া ওই অভিযোগ কেবল অস্বীকারই করেনি; বরং উপহাসের সুরে বলেছে, ব্রিটিশরা নিজেরা ওই কাজ করে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক মহলে চাপে ফেলার জন্য দায় চাপাচ্ছে।

টান টান উত্তেজনাকর ওই পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য ও এর মিত্ররা মিলে শতাধিক রুশ কূটনীতিক বহিষ্কার করে। জবাবে রাশিয়াও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমান সংখ্যক কূটনীতিক বিতাড়িত করে। এরপর গত কয়েকমাস সবকিছু স্বাভাবিক-ই মনে হচ্ছিল। কিন্তু হুট করে আরও রোমাঞ্চকর হয়ে ফিরে এসেছে সেই গোয়েন্দা কাহিনি।

সপ্তাহখানেক আগে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিসিটিভিতে ধারণকৃত দুই সন্দেহভাজনের ছবি প্রকাশ করে বলে যে আলেক্সান্ডার পেটরভ এবং রুসলান বশিরব নামে দুই রাশিয়ান নাগরিক সেরগেই স্ক্রিপালকে হত্যার উদ্দেশে ওই বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। নামগুলো হয়তো তাদের প্রকৃত নাম নয়। দুই ব্যক্তি রাশিয়ার অপরিচিত একটি গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউর সদস্য। গত ২ মার্চ মার্ট তারা গেটউইক বিমানবন্দর দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসেন। উঠেন পূর্ব লন্ডনের একটি হোটেলে। তারা খুব সম্ভবত ‘নিনা নিছি’ ব্র্যান্ডের সুগন্ধির ছোট্ট বোতলে ওই রাসায়নিক বহন করেন। সের্গেই স্ক্রিপালের দরজার হাতলে ওই রাসায়নিক স্প্রে করে ৪ মার্চ তারা যুক্তরাজ্য ত্যাগ করেন।

গত বুধবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক সংবাদ সম্মেলনে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ব্রিটিশরা যে সন্দেভাজনদের ছবি প্রকাশ করেছেন, তাদের খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে এরা সন্ত্রাসী নয়, সাধারণ নাগরিক। দ্রুত তারা জনসমক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করবে বলেও তিনি ঘোষণা দেন।

এর পরদিনই (বৃহস্পতিবার) দুই সন্দেহভাজনের বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রচার করে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টিভি ‘আরটি’ (রাশিয়া টুডে)। এতে দুই সন্দেহভাজন দাবি করেন আলেক্সান্ডার পেটরব ও রুসলান বশিরব তাদের প্রকৃত নাম। নিজেদের ভ্রমণকারী (ট্যুরিস্ট) দাবি করে তারা বলেন, বন্ধুদের পরামর্শে তাঁরা সলসব্যারি শহর দেখতে গিয়েছিলেন। কারণ, সেখানে বিখ্যাত সলসব্যারি ক্যাথড্রাল আছে, যা ১২৩ মিটার দীর্ঘ স্পায়ার এবং প্রাচীন ঘড়ির কারণে ইউরোপসহ বিশ্বে বেশ পরিচিত। তাদের দাবি, ৩ মার্চ তারা সলসব্যারিতে কেবল এক ঘণ্টা অবস্থান করেন। তুষারপাতের কারণে বেশিক্ষণ থাকেননি। তবে পরদিন আবার তাঁরা সলসব্যারি গিয়েছিলেন। পেটরব দাবি করেন, আশপাশের স্টোনহেঞ্জ, ওল্ড সেরামের মতো বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার পরিকল্পনা থাকলেও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তাঁদের যাওয়া হয়নি।

দুই সন্দেহভাজন দাবি করেন, হয়তো ঘটনাচক্রে তাঁরা স্ক্রিপালের বাড়ির সামনে দিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু জানেন না জায়গাটি কোথায়। ‘নোভিচক’ বহনের অভিযোগ অস্বীকার করে তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন—‘নিনা নিচি’ ব্র্যান্ডের সুগন্ধি মেয়েদের। ছেলেদের কাছে এই সুগন্ধির শিশি দেখে বিমানবন্দরের কর্তাদের মনে কি সন্দেহ হতো না? ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভুলভাবে তাদের চিহ্নিত করার কারণে তাদের ও তাদের পরিবারের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে এবং তাঁরা বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছেন বলে দাবি করেন।

ওই সাক্ষাৎকার প্রচার করে মূলত ব্রিটিশদের পাতা ফাঁদেই পা দিল রাশিয়া। ‍দুই সন্দেহভাজনকে তারা জনসমক্ষে হাজির করেছে। এখন সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দুই সন্দেহভাজনের যুক্তরাজ্য সফরের আরও বিস্তারিত প্রকাশ করে ব্রিটিশরা প্রমাণ দিচ্ছে—ওই দুই ব্যক্তিই বিষ প্রয়োগের কাজটি করেছেন।

বিষ প্রয়োগকারী দুই সন্দেজভাজন রুশ চর
বিষ প্রয়োগকারী দুই সন্দেজভাজন রুশ চর

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত সিসিটিভি ফুটেজ বলছে, ৩ মার্চ স্থানীয় সময় বেলা ২টা ২৫ মিনিটে সলসব্যারি রেলস্টেশনে ছিল দুই সন্দেহভাজন। বিকেল ৪টা ১১ মিনিটে আবার তারা একই স্টেশন দিয়ে লন্ডনের রেল ধরে।

পরদিন ৪ মার্চ বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে তাদের আবারও সলসব্যারি স্টেশনে দেখা যায়। ঠিক ১০ মিনিট পর ১১টা ৫৮ মিনিটে তাদের সেরগেই স্ক্রিপালের বাড়ির পাশের রাস্তায় দেখা যায়। বেলা ১টা ৫০ মিনিটে তারা ট্রেন স্টেশনে ফিরে আসে। সন্ধ্যা ৭টা ২৮ মিনিটে হিথরো বিমানবন্দরে তাদের দেখা যায়। এরোফ্লট বিমানের একটি ফ্লাইটে করে তারা মস্কোর উদ্দেশে যাত্রা করে। পরদিন ৫ মার্চ সকালবেলার জন্যও এই দুই ব্যক্তির মস্কো ফেরার টিকিট কাটা ছিল বলে নিশ্চিত হয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ।

যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যমগুলোতে ‘আরটি’র ওই সাক্ষাৎকারের পাল্টা জবাব দেওয়ার ঝড় ওঠে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমগুলোতে প্রশ্ন তোলা হয়, সলসব্যারি শহরের প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়ে ভ্রমণে আসা দুই ব্যক্তি শতাধিক মাইল দূরের লন্ডনের একটি হোটেলে অবস্থান করলেন কেন? তারা কেমন ভ্রমণকারী যে পরপর দুদিন লন্ডন থেকে সলসব্যারি গেলেন এবং মাত্র ঘণ্টা দু-একের মধ্যে ফেরত আসলেন? তাঁরা ভারী তুষারপাতের কারণে সলসব্যারিতে খুব একটা ঘুরতে পারেননি বলে দাবি করেছেন। অথচ সিসিটিভি ফুটেজের প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে তারা শুকনো ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন। এত দূর থেকে সলসব্যারি ক্যাথেড্রাল দেখার জন্য এলেন, অথচ তারা কোনো ছবি তুললেন না? আর ক্যাথেড্রাল দেখতে গেলে ভুল করে স্ক্রিপালের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না দাবি করে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বলছে, কারণ বাড়িটা ক্যাথেড্রালের উল্টো পথে কয়েক কিলোমিটার দূরে। প্রশ্ন তোলা হয়—দেশে ফেরার জন্য পরপর দুদিনের এয়ার টিকিট করে রাখে—এরা কেমন ট্যুরিস্ট?

রাশিয়ার পক্ষ থেকে এসব প্রশ্নের কোনো জবাব এখনো পাওয়া যায়নি।

দুই সন্দেহভাজনের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আরটির প্রধান বার্তা সম্পাদক মার্গারিতা সিমোনিয়ন। ওই সাক্ষাৎকারের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শুক্রবার রাতে বিবিসির একটি অনুষ্ঠানে টেলিফোনে যোগ দিয়েছিলেন মার্গারিতা। তাঁকে সাক্ষাৎকারের ধরন নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হয়। জানতে চাওয়া হয় যে রাশিয়ার মিথ্যাচার প্রচারের অংশ হিসেবে ওই সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছে কি না? জবাবে মার্গারিতা বলেন, এমন প্রশ্ন রাশিয়া সম্পর্কে গতানুগতিক পশ্চিমা ধারণারই বহিঃপ্রকাশ। তিনি অসৌজন্যমূলকভাবে টেলিফোন লাইন কেটে দেন।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে রাশিয়ান টিভির সাক্ষাৎকারকে চরম ‘মিথ্যাচার এবং বিকৃত উপস্থাপন’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। তিনি বলেন, এমন আচরণ ভুক্তভোগী ও তাদের প্রিয়জনদের প্রতি চরম অবমাননাকর। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট এক টুইট বার্তায় বলেন, ভুয়া টিভি শো বন্ধের সময় এসেছে—এর মাধ্যমে বিশ্ব রাশিয়াকে চিনছে।

এই সুগন্ধির শিশিতে করে বিষ বহন করা হয় বলে ধারণা।
এই সুগন্ধির শিশিতে করে বিষ বহন করা হয় বলে ধারণা।

আর দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেন, দুই ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। রাশিয়া তাদের নাগরিকদের যুক্তরাজ্যে বিচারের জন্য পাঠাবে না—এটা জানা কথা। তবে ওই দুই ব্যক্তি কখনো রাশিয়ার বাইরে অন্য কোনো দেশে পা রাখলেই গ্রেপ্তার হবেন বলে তিনি ঘোষণা দেন।

সর্বশেষ যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির আসন্ন বার্ষিক সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের রাশিয়ান দূতাবাসের কাউকে আমন্ত্রণ দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রুশ দূতাবাস। তারা বলেছে, দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন বিভিন্ন সময়ে ছিল। কিন্তু সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর ঐতিহ্যে সেটি কখনো বাধা হয়নি।

গত ৪ মার্চ যুক্তরাজ্যের সলসব্যারি শহরের একটি বিপণিকেন্দ্রে বাইরে বেঞ্চিতে স্ক্রিপাল (৬৬) ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপালকে (৩৩) অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, তাঁদের দুজনের ওপর নার্ভ এজেন্ট (বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস) প্রয়োগ করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্য শুরু থেকেই দাবি করে আসছে, রাশিয়ার গুপ্তচররাই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ের ওপর ওই গ্যাস প্রয়োগ করেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের দাবি, তাঁর দেশ পরীক্ষা করে প্রমাণ পেয়েছে, এই নার্ভ এজেন্ট রাশিয়ার তৈরি। যার নাম ‘নোভিচক’।

সেরগেই স্ক্রিপাল একসময় রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্নেল ছিলেন। ২০০৬ সালে তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ ওঠে। রাশিয়ায় তাঁর ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। এরপর ২০১০ সালে ১০ জন মার্কিন গুপ্তচরের বিনিময়ে স্ক্রিপাল রাশিয়ার হাত থেকে ছাড়া পান। ওই বছরই স্ক্রিপাল যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন।

স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে বেঁচে গেছেন। কিন্তু নোভিচকের সংস্পর্শে এসে ৩০ জুন আরেক দম্পতি অসুস্থ হয়েছে পড়েন এবং ৪৪ বছর বয়সী ডন স্টারগেস মারা যান।