হ্যাশট্যাগ মিটুতে বেরিয়ে আসছে যৌন হেনস্তা

বলিউডের অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত অভিনেতা নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ তুলেছেন। ছবি: রয়টার্স
বলিউডের অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত অভিনেতা নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ তুলেছেন। ছবি: রয়টার্স

হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনে তোলপাড় বলিপাড়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক ‘অপরাধীর’ নাম প্রকাশ করছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা। অভিনেতা, কৌতুক অভিনেতা, সাংবাদিক, লেখক, পরিচালক থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রের পুরুষের বিরুদ্ধে উঠছে যৌন হেনস্তার অভিযোগ। তবে এই আন্দোলন কতটুকু সফল হবে বা কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনাও হচ্ছে। আদৌ তাঁরা নির্যাতনের শিকার, না তাঁদের সম্মতিতে এমনটা ঘটেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেক বিখ্যাত মানুষও।

আসলে নারীদের এই অভিযোগের শুরুটা কবে থেকে, তা বলা মুশকিল। যুগ যুগ ধরেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। তবে সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে মুখে এঁটে রেখেছেন কুলুপ। এবার বাঁধ ভাঙার সময় এসেছে বলে মনে করছেন তাঁরা। ২০১৭ সালে আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে ৫০ জন অধ্যাপকের এক তালিকা দেন, যাঁরা যৌন হেনস্তা করতেন ছাত্রীদের। তবে ওই ঘটনা যতটা আলোড়ন সৃষ্টি করে, এর চেয়ে অনেক বেশি তোলপাড় এখন বলিউড। কারণ, এবার অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিরা সবাই বেশ পরিচিত মুখ। সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে, এমনকি অসংগতিগুলো দূর করতে প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা বেশ সরব।

গত বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ে কৌতুক অভিনেতা উৎসব চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন আরেক নারী কৌতুক অভিনেতা। ৩৩ বছরের উৎসব অল্প বয়সী ওই নারী অভিনেত্রীকে নোংরা বার্তা পাঠাতেন। ওই নারী টুইটারে এই ঘটনার কথা প্রকাশ করেন। এরপর একাধিক টুইটের মাধ্যমে ওই নারী বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে জানান, উৎসব কীভাবে দিনের পর দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নগ্ন ছবি চাওয়ার পাশাপাশি অশালীন মন্তব্য করে যৌন হেনস্তা করে গেছেন নারীদের। ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীর সঙ্গে উৎসবের কথোপকথনের স্ক্রিনশটও শেয়ার করেন তিনি। ওই নারী জানান, গ্রুপের বিশিষ্ট নারীবাদী কৌতুক অভিনেতাদের জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর উৎসব তাঁদের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।

এই অভিযোগ ওঠার পরদিন উৎসব চক্রবর্তী নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চান। এরপর আরও অনেক নারী আরও অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে তুলে ধরেন অজানা গল্পের জগৎ। গত তিন দিনে কৌতুক অভিনেতা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক, জনপ্রিয় লেখক, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে এসেছে। হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনে জ্বলছে বি টাউন।

ভারতে একের পর এক নারী সাংবাদিক তাঁদের সাবেক সম্পাদক, ব্যুরো চিফ বা ঊর্ধ্বতন বসের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার অজস্র অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সামনে আনতে শুরু করেছেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন, কোথাও আবার সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিষ্ঠান অভিযোগের যথাযথ তদন্ত করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। তবে তারপরও প্রভাবশালী এই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদৌ শাস্তির আওতায় আনা যাবে কি না, পর্যবেক্ষকেরা তা নিয়ে সন্দিহান।

বলিউডে অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত অভিনেতা নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ তুলেছেন। এই নিয়ে যখন তোলপাড় সারা ভারত, তখনই হায়দরাবাদে টাইমস অব ইন্ডিয়ার বর্তমান রেসিডেন্ট এডিটরের বিরুদ্ধে ১০ বছর আগে ঘটা একটি যৌন লাঞ্ছনার অভিযোগ তোলেন সাংবাদিক সন্ধ্যা মেনন। সেই শুরু, তারপর একে একে মুম্বাইতে ডিএনএর সাবেক প্রধান সম্পাদক গৌতম অধিকারী, হিন্দুস্তান টাইমসের অন্যতম সম্পাদক প্রশান্ত ঝাসহ বহু জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করে ফেসবুক ও টুইটারে।

ভারতে মিডিয়া হাউসগুলো এতটাই শক্তিশালী যে তার বড় নামগুলো এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ভারতে বিবিসির উইমেন্স ও সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক গীতা পান্ডে। তিনি বলেন, ‘দু-একটি মাঝারি মানের সাংবাদিকের নাম ছাড়া সত্যিকারের বড় নামগুলো খুব একটা এখনো আসেনি—মানে ভারতীয় সাংবাদিকতার যাঁরা হার্ভে ওয়াইনস্টিন, তাদের এখনো আমরা পাইনি।’

ভারতে একের পর এক নারী সরব হচ্ছেন হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনে।
ভারতে একের পর এক নারী সরব হচ্ছেন হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনে।

সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জি বিভিন্ন অভিযোগ সংকলন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অচিরেই আরও নাম আসবে এবং সাংবাদিকতার রাঘববোয়ালরাও হয়তো বাদ যাবেন না। তিনি বলেন, ‘এখন কিন্তু শত শত মেয়ে এগিয়ে আসছেন। আমাকে রোজ প্রচুর মেয়ে ব্যক্তিগতভাবে বার্তা পাঠাচ্ছেন। সেসব বার্তায় লেখা, “আমারও কিন্তু একটা স্টোরি আছে। প্লিজ, একটু শুনবেন?” আমরা ধৈর্য ধরে সেসব গল্পই শুনছি, তারপর সবদিকে আটঘাট বেঁধে সেগুলো অভিযোগের আকারে প্রকাশ করছি।’

ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জি আরও বলেন, ‘আসলে মিডিয়া হোক বা হলিউড-বলিউড-বিজ্ঞাপন বা কৌতুকের দুনিয়া, মেয়েদের চিরকালই একটা “হুইসপার নেটওয়ার্ক” থাকে। যেখানে তারা পরস্পরকে চিরকাল সতর্ক করে এসেছে অমুক লোকটা কিন্তু সুবিধার নয়, অমুকের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ।’

তনুশ্রীর ঘটনা প্রকাশের পর অভিযোগ উঠেছে লেখক চেতন ভগত, কৌতুক অভিনেতা উৎসব চক্রবর্তী, তন্ময় ভট্ট ও গুরসিমরন খাম্বার বিরুদ্ধে। গত রোববার টুইটারে ক্ষমা চেয়েছেন অভিনেতা রজত কাপুর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছেন দুই নারী। তাঁদের মধ্যে একজন দাবি করেন, প্রায় ১০ বছর আগে অভিনেতা সৌরভ শুক্লর নম্বর থেকে তাঁকে বারবার ফোন করে বিরক্ত করতেন রজত। একটি ছবি শুট করার জন্য ফাঁকা বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয় তাঁকে। অন্য অভিযোগকারী পেশায় সাংবাদিক। তিনি জানান, ফোনে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ে তাঁকে নানা আপত্তিকর প্রশ্ন করেছিলেন রজত।

পরে এক টুইট বার্তায় রজত বলেন, ‘আমি সব সময়ে ঠিক কাজ করার চেষ্টা করেছি। যদি কখনো আমার কথায় বা কাজে কেউ আঘাত বা ব্যথা পেয়ে থাকেন, তাঁদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’

পরিচালক বিকাশ বহেলের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ জানিয়েছিলেন ফ্যান্টম ফিল্মসের এক নারী কর্মী। অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌতও বিকাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যামাজন প্রাইমের একটি সিরিজ পরিচালনা থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে বিকাশকে। ‘সুপার থার্টি’র প্রচার থেকেও তাঁকে দূরে রাখা হবে। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অভিনেতা হৃতিক রোশনও। অপরাধীর বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।