চীনের মরুভূমির শিবিরে আটক লাখো মুসলমান

গুগল আর্থ-এ চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের দাবানচেং শহরের স্থাপনা। ছবিটি গত এপ্রিলের।  ছবি: বিবিসি
গুগল আর্থ-এ চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের দাবানচেং শহরের স্থাপনা। ছবিটি গত এপ্রিলের। ছবি: বিবিসি
>

• বিবিসির অনুসন্ধান
• চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রায় এক কোটি লোকের বাস।
• আটক রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীন।

চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে বিচার ছাড়াই লাখো মুসলমানকে আটক করে রাখার অভিযোগ উঠেছে। তারা উইঘুর সম্প্রদায়ের। তবে চীন সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছে, ওই মানুষদের আটক রাখা হয়নি। তারা বিশেষ ‘কারিগরি বিদ্যালয়ে’ স্বেচ্ছায় ভর্তি হয়েছে। ওই বিদ্যালয়গুলোতে ‘সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থার’ বিরুদ্ধে লড়াই শেখানো হয়। তবে বিবিসির অনুসন্ধানে বাস্তবতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে।

জিনজিয়াং চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এর বড় অংশজুড়ে রয়েছে মরুভূমি ও পাহাড়ি এলাকা। এই অঞ্চলে মুসলমান উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রায় এক কোটি লোকের বাস। এ ছাড়া আরও অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ রয়েছে সেখানে।

২০১৫ সালের ১২ জুলাই একটি কৃত্রিম উপগ্রহ জিনজিয়াং এবং চীনের সর্ব পশ্চিম প্রান্তের শহরগুলোর ওপর দিয়ে যায়। ওই সময় উপগ্রহের তোলা ছবিগুলোর মধ্যে একটিতে দেখা যায়, জিনজিয়াংয়ের বিশাল মরু এলাকাটি জনশূন্য পড়ে আছে। কিন্তু চলতি বছরের ২২ এপ্রিল আরেকটি কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা একই এলাকার ছবিতে নতুন কিছুর অস্তিত্ব দেখা যায়। তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে সেখানে বিশাল এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। দেখতে অনেকটা শিবিরের মতো। ওই স্থাপনার বাইরে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ দেয়াল। ওই দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ১৬টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে।

বৈশ্বিক মানচিত্রবিষয়ক সফটওয়্যার গুগল আর্থ-এ শিবিরটির অবস্থান দেখানো হয়েছে জিনজিয়াংয়ের ছোট শহর দাবানচেংয়ের পাশে। ওই স্থাপনার ব্যাপারে সরেজমিনে খোঁজ নিতে বিবিসির একটি দল দাবানচেং শহরে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে। সেখানে তাঁরা যে স্থাপনা দেখেছেন, তা জিনজিয়াং অঞ্চলে গড়ে তোলা অনেক বন্দিশিবিরের একটি। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ওই স্থাপনাগুলো ‘পুনর্শিক্ষণ বিদ্যালয়’। আরেকজন বলেন, ওই স্থাপনাগুলোয় চরমপন্থা দমনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আইনি বিধান, কর্মদক্ষতার উন্নয়ন এবং চীনা ভাষার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত উইঘুর সম্প্রদায়ের রেয়িলা আবুলাইতি বলেন, গত বছর তাঁর মা যুক্তরাজ্যে তাঁর কাছে বেড়াতে এসেছিলেন। গত ২ জুন তিনি জিনজিয়াংয়ে ফেরেন। তিনি নিরাপদে বাড়ি ফিরেছেন কি না জানতে রেয়িলা টেলিফোন করেন। রেয়িলা বলেন, ‘মা বললেন, পুলিশ বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে। এরপর মা শুধু বললেন, “আমাকে আর কখনো টেলিফোন করবে না”।’ রেয়িলার ধারণা, তাঁর মাকে বন্দিশিবিরে আটক করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি যত দূর জানি, চীন সরকার উইঘুর পরিচয়টি বিশ্ব থেকে মুছে ফেলতে চায়।’

উইঘুর সম্প্রদায়ের আটজন প্রবাসীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। এসবই যেন সাক্ষ্য। তাঁদের মধ্যে ২৯ বছর বয়সী আবলেত তুরসান তোহতি বলেন, বন্দিশিবিরে থাকা অবস্থায় প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠতে হতো তাঁদের। এক মিনিটের মধ্যে শরীরচর্চার জন্য মাঠে পৌঁছাতে হতো। এরপর লাইন ধরে দৌড় শুরু হতো। যাঁরা জোরে দৌড়াতে পারতেন না, তাঁদের বিশেষ কক্ষে নিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। ওই কক্ষে দুজন লোক থাকতেন। একজন চাবুক মারার মতো বেল্ট দিয়ে পেটাতেন, অন্যজন শুধু লাথি মারতেন।

আবলেত তুরসান তোহতি আরও বলেন, তিনি যেকোনোভাবেই হোক বন্দিশিবির থেকে ছাড়া পেয়ে তুরস্কে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে তাঁর ৭৪ বছর বয়সী বাবা এবং ৮ বছর বয়সী ছোট ভাই শিবিরে রয়ে গেছে।

৪১ বছর বয়সী আরেক উইঘুর আবদুসালাম মুহেমেতও তুরস্কে রয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে জিনজিয়াং থেকে তিনি আটক হন। এরপর ‘শিক্ষিত’ করে তোলার কথা বলে তাঁকে নেওয়া হয় বন্দিশিবিরে। ২০১৫ সালে আটক হন ২৫ বছর বয়সী আলী (প্রকৃত নাম নয়)। বন্দিশিবিরে এক দিনের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, সেদিন তাঁরা দৌড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ শিবিরের প্রধান ফটক দিয়ে একজন কর্মকর্তার গাড়ি ঢুকল। ওই সুযোগে উইঘুর সম্প্রদায়ের আটক এক নারীর শিশুসন্তান দৌড়ে ঢুকে পড়ল শিবিরের ভেতর। সে সোজা তার মায়ের কাছে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা ওই নারীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে একদিকে নিয়ে যান। আর শিশুটিকে টেনেহিঁচড়ে ফটকের বাইরে রেখে আসেন।

গত চার বছরে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করেছে প্রশাসন। তাঁদের পরিচয়ই তাঁদের রেখেছে সরকারের সন্দেহের মধ্যে। উইঘুরদের বিনা বিচারে, বিনা অভিযোগে আটক রেখে ‘পুনর্শিক্ষণ’ কর্মসূচিকে সফল বলে দাবি করেছে চীন।