আর্যাবর্তের রাজনীতি এখন রামময়

ভারতে সাধারণ নির্বাচনের দিন যত এগোচ্ছে, আর্যাবর্তের রাজনীতি ততই হয়ে উঠছে রামময়। নরম হিন্দুত্ব থেকে রাজনীতির উত্তরণ ঘটছে কট্টর হিন্দুত্ববাদে।

উত্তর প্রদেশ দখলে রাখতে বিজেপি মরিয়া। অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সুপ্রিম কোর্টের ‘টালবাহানার’ সরব প্রতিবাদের মধ্যেই রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি শুধু নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি, মন্দির নির্মাণ কর্মসূচিকেই ক্রমশ করে তুলছে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনীতিকে করে তুলছে রামময়।

সেই জন্য দীপাবলির চেয়ে উপযুক্ত উৎ​সব আর কী হতে পারে? অযোধ্যায় তিন দিন ধরে চলছে দীপাবলির উৎ​সব। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সেই উপলক্ষকে হাতিয়ার করে গতকাল মঙ্গলবার ফৈজাবাদ জেলা শহরের নাম বদলে দিয়েছেন। ফৈজাবা​দ নাম বদলে হলো অযোধ্যা। এর কদিন আগেই তিনি বদলে দিয়েছিলেন ‘সঙ্গম শহর’ নামে পরিচিত এলাহাবাদের নাম। নতুন নাম প্রয়াগরাজ।

নাম বদলের এই প্রতিযোগিতায় থেমে নেই বিজেপি শাসিত অন্য রাজ্যও। আদিত্যনাথের দেখানো পথে হেঁটে গুজরাটের উপমুখ্যমন্ত্রী নীতিন প্যাটেল আজ বুধবার বলেছেন, মানুষের সমর্থন পেলে ও আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে আহমেদাবাদ শহরের নাম বদলে কর্ণাবতী রাখা হবে। দ্বাদশ শতকে চালুক্যরাজ কর্ণভিল রাজা আশাবলকে যুদ্ধে হারিয়ে সবরমতী নদীর ধারে কর্ণাবতী শহর গড়ে তুলেছিলেন। পঞ্চদশ শতকের গোড়ায় সুলতান আহমেদ শাহ এরই পাশে গড়ে তোলেন নতুন শহর আহমেদাবাদ।

এলাহাবাদ ও ফৈজাবাদের নাম বদলের মধ্যেই আদিত্যনাথ থেমে থাকতে রাজি নন। তিনি ঘোষণা করেছেন, অযোধ্যাতেই তৈরি করা হবে রামচন্দ্রের বিশালাকার মূর্তি। সেই মূর্তির উচ্চতা হবে ১৫০ মিটার। তা স্থাপিত হবে ৫০ মিটার উঁচু এক বেদীর ওপর। রামচন্দ্রের ওই মূর্তিকে কেন্দ্র করে গোটা অযোধ্যা গড়ে উঠবে আন্তর্জাতিক এক পর্যটনস্থল হিসেবে। দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা যা দেখতে আসবেন। যাকে কেন্দ্র করে বদলে যাবে স্থানীয় অর্থনীতি। এ ছাড়া অযোধ্যায় বিমানবন্দর গড়ে তোলার কথাও মুখ্যমন্ত্রী শুনিয়েছেন। সেই বিমানবন্দরের নামও রাখা হবে রামচন্দ্রের নামে। বলেছেন, তৈরি হবে এক মেডিকেল কলেজও। তার নামকরণ হবে রামের বাবা রাজা দশরথের নামে।

রামমূর্তি গড়ার দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে, সেটাও মোটামুটি ঠিক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ভাস্করকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি তৈরির, সেই রাম ভি সুতারের নামই ভেবে রেখেছেন আদিত্যনাথ। প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছে, সরযু নদীর কিনারে গড়া হবে ওই রামমূর্তি। তবে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, স্থান নির্বাচন এখনো চূড়ান্ত নয়।

অযোধ্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হলে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের বিতর্কিত স্থলে রামমন্দির তৈরি করা কঠিন। মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে রয়েছে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারির আগে শুনানি সম্ভব নয়। এর ফলে ২০১৯ সালের ভোটে জিততে বিজেপি মন্দির আন্দোলনকে নতুনভাবে হাতিয়ার করতে চাইছে। ১৯৮৯ সালে অযোধ্যায় বিতর্কিত স্থানে রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়েছিল। ১৯৯১ সালে হয় বাবরি মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার করসেবা। ১৯৯২ সালে ধূলিসাৎ​ হয় বাবরি মসজিদ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিকভাবে লাভ হয়েছিল বিজেপির। ২০১৪ সালে একক ক্ষমতায় সরকারে আসা বিজেপি ২০১৯-এর নির্বাচনী বৈতরণি পেরোনোর প্রধান সহায় করতে চাইছে এই মন্দিরকেই।

ভোট যত এগোচ্ছে, বিরোধীদের জোটবদ্ধ হওয়ার তাগিদ যত বাড়ছে, বিজেপি ততই সচেষ্ট আর্যাবর্তে ধর্মীয় মেরুকরণে। বিরোধী জোট তাদের কী হাল করতে পারে, কর্ণাটকের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনই তার প্রমাণ। দাক্ষিণাত্যের ওই রাজ্যে কংগ্রেস-জেডিএস জোট বিজেপিকে ধরাশায়ী করে ৫টির মধ্যে ৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির জোটবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। জোটবদ্ধ রাজনীতির মোকাবিলায় বিজেপি তাই ফিরতে চাইছে রামমন্দির আন্দোলনের দিনগুলোয়।