এবার গৃহবিবাদ মেটানোই যুক্তরাজ্যের আসল চ্যালেঞ্জ

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ বিষয়ে একটি খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করেছে উভয় পক্ষ। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর যাবৎ দফায় দফায় বৈঠক, পাল্টাপাল্টি বিবৃতি আর দর-কষাকষির পর তারা সমঝোতায় এল। তবে খসড়া চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ হওয়ার আগেই যুক্তরাজ্যে এ নিয়ে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। মতপার্থক্য নিরসন করে এ চুক্তি সম্পাদনে মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদের অনুমোদন আদায় করাটাই এখন থেরেসা মের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ফাঁস হওয়া খসড়া চুক্তির বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয়ারল্যান্ড সীমান্ত নিয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ায় আপাতত ইইউর কাস্টমস ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থাকবে যুক্তরাজ্য। এ জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমদানি-রপ্তানিতে ইইউর আইন মেনে চলতে হবে যুক্তরাজ্যকে। যুক্তরাজ্য চাইলেই কাস্টমস ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন কমিটির মতামতের প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া উভয় পক্ষের নাগরিকদের অধিকার ও ৩৯ বিলিয়ন পাউন্ডের বিচ্ছেদ বিল (যুক্তরাজ্যের কাছে ইইউর পাওনা) পরিশোধের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার পর ২১ মাস যাবৎ অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বর্তমান সম্পর্ক বজায় থাকবে।

তবে খসড়া চুক্তিতে বিচ্ছেদ–পরবর্তী সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি কিছু উল্লেখ নেই। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে কোনো সমঝোতা এখনো হয়নি।

আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে স্থানীয় সময় বেলা দুইটায় মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক ডাকেন। এর আগে সকাল থেকেই প্রত্যেক মন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা আলাদা (ওয়ান টু ওয়ান) বৈঠক করেন। খসড়া চুক্তি সম্পর্কে তিনি মন্ত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে যুক্তরাজ্য সর্বোচ্চটাই আদায় করার চেষ্টা করেছে।

প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এ খসড়া চুক্তিতে স্বাক্ষরের আগে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন নিতে হবে। তারপর ইইউ সদস্যদেশগুলোর অনুমোদনের জন্য ২৮ নভেম্বর বিশেষ সম্মেলন আয়োজনের কথা রয়েছে। সেখানে অনুমোদন পেলে চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে উভয় পক্ষ।

এখানেই শেষ নয়। চুক্তি কার্যকর করতে হলে থেরেসা মেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে হবে। অন্যদিকে ইইউ সদস্যদেশগুলোর পার্লামেন্টে চুক্তির অনুমোদন দিতে হবে। তবেই কার্যকর হবে এ চুক্তি। সব পর্ব শেষ করে ডিসেম্বরে বড় দিনের ছুটির আগেই চুক্তিটি পার্লামেন্টে তুলতে চান মে। সেখানেই তিনি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

বিচ্ছেদপন্থীদের পাশাপাশি বিচ্ছেদবিরোধী এমপিরাও এই খসড়া চুক্তির বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। বিচ্ছেদপন্থী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন খসড়া প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এমন যে কারও জন্যই এই চুক্তি অগ্রহণযোগ্য।’ থেরেসা মের ব্রেক্সিট প্রস্তাবের বিরোধিতা করে গত জুলাইয়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন বরিস। বিচ্ছেদপন্থী আরেক শীর্ষ নেতা জেকব রিস-মগ বলেন, চুক্তি নিয়ে তিনি খুব অসন্তুষ্ট। তিনি থেরেসা মের পদত্যাগের ডাক দেবেন। ক্ষমতাসীন দলীয় এমপি জেকব কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী কনজারভেটিভ এমপিদের সংগঠন ইউরোপিয়ান রিসার্চ গ্রুপের নেতা। বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, ‘চুক্তি দেখিনি, তবে বলা যায় এটি জাতির জন্য ভালো কিছু হবে না।’ চুক্তির বিস্তারিত দেখে মতামত ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

তবে যে ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির (ডিইউপি) ওপর ভর করে থেরেসা মে সরকারে আছেন, সেই দলটি খসড়া চুক্তিতে সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছে। নর্দান আয়ারল্যান্ডের এই দলটির প্রধান অ্যারলেন ফোস্টার বলেছেন, খসড়া চুক্তি নর্দান আয়ারল্যান্ডকে যুক্তরাজ্যের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এটি যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতার বিরোধী।

ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের এই বিচ্ছেদ ব্রেক্সিট (যা ব্রিটেন এক্সিটের সংক্ষেপিত রূপ) নামে পরিচিত। ২০১৬ সালের এক গণভোটে যুক্তরাজ্যের মানুষ ইইউর সঙ্গে বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দেয়। এ নিয়ে রাজনৈতিক নানা নাটকীয়তার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন থেরেসা মে। তিনি বিচ্ছেদ কার্যকরের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেন।
সমঝোতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় যুক্তরাজ্য ও ইইউর মধ্যকার আয়ারল্যান্ড সীমান্ত। স্বাধীন আয়ারল্যান্ড ইইউর সদস্য। আর বিচ্ছেদের পর যুক্তরাজ্যের অংশ নর্দান আয়ারল্যান্ড, ইইউ থেকে বেরিয়ে আসবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীন আয়ারল্যান্ড ও নর্দান আয়ারল্যান্ডের মধ্যে কোনো সীমান্ত বাধা থাকবে না বলে চুক্তিবদ্ধ যুক্তরাজ্য। তাই দুই আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার সীমানা উন্মুক্ত রেখে বিচ্ছেদ কার্যকর করাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।