আহমেদাবাদ শহর যখন উদাহরণ

ভারতের দিল্লি, মুম্বাইসহ বড় শহরগুলো ঘিঞ্জি। যেখানে–সেখানে ঘরবাড়ি, অলিগলি, রাস্তাঘাট, নালা, বস্তি। রাস্তায় বের হলেই জানা নেই গন্তব্যে কখন পৌঁছানো যাবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কর্মসময় নষ্ট হয় রাস্তাতেই। সবকিছু মিলিয়ে বিপর্যস্ত এ জনজীবনের ছবি ভালো বোঝা যায় উড়োজাহাজ থেকে। নিচে তাকালে দেখা যায়, কতটা অপরিকল্পিতভাবে এসব নগর গড়ে উঠেছে। তবে এসব নগরকে ছাপিয়ে উদাহরণ হয়ে উঠেছে গুজরাটের আহমেদাবাদ শহর।

আহমেদাবাদ শহরে ৬০ লাখ মানুষের বাস। প্রতিবছর শহরটি জনসংখ্যায় ও আকারে বাড়ছে। তবে তা পরিকল্পিত উপায়ে। মহানগর শহরের কাছাকাছি থাকা জমিগুলো অধিগ্রহণ করে পরিকল্পিত উপশহর গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব জমির ওপর দিয়ে তৈরি হচ্ছে সোজা রাস্তা। আর টুকরো টুকরো জমিগুলোয় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি, অফিস ও পার্ক। কিছু কিছু দিক লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই শহর যেন আধুনিক ভারতীয় শহরের তুলনায় উনিশ শতাব্দীর বার্সেলোনা বা নিউইয়র্কের মতো।

শহরের এক বাসিন্দা শিবাজি। নিজের ইটের ছোট্ট বাড়ির চারপাশের জমিতে চাষবাস করেন। কিন্তু এখন শহর যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। দুই বছর আগে হঠাৎ করেই ভারতীয় কিছু রুপি বাতিল হয়ে গেলে তিনি বেশ বেকায়দায় পড়েন। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের কিছু জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন। এখন সেই সবুজ জমির ওপর দিয়ে সরকারি এক পরিকল্পিত প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে। এরই মধ্যে এই জমির নিচ দিয়ে একটি পয়োনিষ্কাশনের লাইন তৈরি হয়েছে।

আহমেদাবাদের সেপ্ট ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট বিমল প্যাটেল দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, ভারতের বেশির ভাগ শহরই অগোছালো। উনিশ ও বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ও আমেরিকান শহরগুলো যখন আকারে–আয়তনে বেড়ে উঠছিল, তখন এগুলোর চারপাশে ছিল বিশাল বিশাল জমি। তারা সেখানে গড়ে তুলেছে সুপরিকল্পিত উপশহর। কিন্তু ভারতের শহরের প্রান্তে থাকা জমি হচ্ছে ছোট ছোট। কোনো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান যখন একখণ্ড জমিতে ঘরবাড়ি গড়ে তোলে, তখন উপশহরের বড় রাস্তাগুলো বা অন্যান্য অবকাঠামো কোথায় গড়ে উঠবে, সেই পরিকল্পনা তাদের থাকে না। আর বস্তিগুলোর অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। সেখানে ভূগর্ভস্থ সুয়ারেজ লাইনও থাকে না।

কিন্তু আহমেদাবাদ নগর গড়ে উঠছে ভিন্নভাবে। সেখানে দুই ধরনের পৌর কর্তৃপক্ষ রয়েছে। একটি কর্তৃপক্ষ মূল শহরের দেখভাল করে। আর অন্যটি আহমেদাবাদকে ঘিরে থাকা বড় বড় জমি অধিগ্রহণ করে তা উন্নয়ন করে। এই উপশহর গড়ে তুলতে তারা দুই–পঞ্চমাংশ জায়গা সড়ক, স্কুল, পার্ক, সোশ্যাল হাউজিংসহ বিভিন্ন স্থাপনার জন্য রাখে। এরপর তারা শত বছরের পুরোনো সাবেক ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা আইন প্রয়োগ করে ব্লকের সব ভূমি হোল্ডিংদের চিহ্নিত করে। তাদের নতুন রোড গ্রিড তৈরির জন্য রাজি করায়। জমিগুলোর আঁকাবাঁকা সীমানাকে সরলরেখায় নিয়ে আসে। এ জন্য কর্তৃপক্ষ কৃষকদের অর্থ দেয়, আবার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য তাদের কাছ থেকে অর্থও নেয়। এ ক্ষেত্রে সচরাচর জমির দাম অনেক বেশি দেওয়া হয়, তাই সবাই সানন্দে এগিয়ে আসেন।

এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় কৃষকেরা হঠকারিতার শিকার হন। শিবাজির কাছ থেকে জমিক্রেতা পঙ্কজ প্যাটেল এমন অনেক ঝামেলার উদাহরণ তুলে ধরেন। যেমন: একদল লোক আছে, যারা কোনো এলাকার উন্নয়ন হবে জানতে পেরে সেখানকার কৃষকদের ভুলভাল বুঝিয়ে কম দামে জায়গা হাতিয়ে নেয়। অধিগ্রহণ করা পুনর্গঠিত জায়গায় প্রত্যেকেই অভিযোগ করেন, তার চেয়ে প্রতিবেশীর জায়গাটি বেশি ভালো। অনেকে আবার জমির ভালো দাম পাওয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেন। ধনী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা, যাঁদের কাছে অনেক খাসজমি রয়েছে, তাঁরা এই উন্নয়নকাজকে ঠেকাতে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।

তবে কোনো সমস্যাই তেমন বড় নয়। যেখানেই অধিগ্রহণ করার আয়োজন শুরু হয়, সেখানে অনেক সময় বিক্ষোভের কারণে কাজটি মুখ থুবড়ে পড়ে বা ধীর হয়ে যায়। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনেক সময় তীব্র ক্ষোভের মুখেও সড়কের পাশে ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ করে দেয়। নগর-পরিকল্পনার স্কিমগুলো নমনীয়। ৭৬ কিলোমিটার সড়কের জন্য ৪৭টি স্কিমে জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং মাত্র চার বছরে ওই সড়ক তৈরি হয়। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক অ্যাটলাস অব আরবান এক্সপানশন প্রকল্পের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০০০ সালের পর আহমেদাবাদের সড়কগুলো গড়ে সাড়ে আট মিটার প্রশস্ত হয়েছে; আগেরগুলো যেখানে ছিল ৭ দশমিক ২ মিটার। নতুন করে গড়ে ওঠা উপশহরগুলোয় সড়কের জন্য অনেক জায়গা রাখা হয়। দিল্লি বা মুম্বাইয়ে যেখানে প্রচণ্ড যানজট হয়, সেখানে ভবিষ্যতে দেখা যাবে আহমেদাবাদের উপশহরের রাস্তাগুলোয় স্বচ্ছন্দে চলতে পারবে গাড়িগুলো।

২০০১ সালে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত গুজরাটের ভুজ শহরে আহমেদাবাদের এই উদাহরণ কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন চলছে। পাশের রাজ্য মহারাষ্ট্রও এই নগর-পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। অন্য রাজ্যগুলো আগ্রহী। জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা এই নগর-পরিকল্পনাকে থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।