মৃণাল সেন চেয়েছিলেন অনাড়ম্বর শ্রদ্ধার্ঘ্য

মৃণাল সেন
মৃণাল সেন

বাংলা সিনেমার মহিরুহ ও প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের মরদেহ শায়িত রয়েছে কলকাতার হিমঘর পিস ওয়ার্ল্ডে। গতকাল রোববার সকালে মৃণাল সেন কলকাতার ভবানীপুরের নিজ বাসভবনে মারা যান। তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাঁর দেহে ফুলমালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো না হয়।

 গতকাল বিকেলে মৃণাল সেনের মরদেহ পিস ওয়ার্ল্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। আগামী বুধবার তাঁর একমাত্র ছেলে কুণাল সেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো থেকে ফিরবেন। এরপর বিনা আড়ম্বরে মৃণাল সেনের শেষকৃত্য হবে।

মৃণাল সেনের মৃত্যুতে কলকাতার টালিউডের পাশাপাশি মুম্বাইয়ের বলিউডে শোকের ছায়া নেমে আসে। বলিউডের তারকারা শোক প্রকাশ করে বলেছেন, একটি যুগের অবসান হলো। সেই যুগের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেন।

অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘মৃণাল সেনের মৃত্যুতে আমি শোকাহত। উনি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের সমতুল্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন শিল্পী এবং আমার বন্ধু বটে। আমি ওনার ছবি “ভুবন সোম”–এ প্রথম কণ্ঠ দিয়েছিলাম। মৃণাল সেনের আত্মার শান্তি কামনা করি।’

বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা মধুর ভান্ডারকর লিখেছেন, ‘তিনি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এবং সমাজ নির্মাণে বিপ্লব এনেছিলেন। এনেছিলেন জাগরণ।’

চিত্রনির্মাতা মহেশ ভাট কবিগুরুর গানের লাইন উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহ ভাই, সবারে প্রণাম করে যাই। এই মৃণালদা আমার জীবনে নতুন স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে স্পর্শের কথা চিরদিন হৃদয়ে জেগে থাকবে।’

মৃণাল সেনের বাড়ি। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
মৃণাল সেনের বাড়ি। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

বলিউড তারকা নন্দিতা দাস লিখেছেন, ‘এখন থেকে মৃণালদার কথা পাস্ট টেন্সে লিখতে হবে, তা ভাবতেই পারছি না। মৃণালদা নিজেই একটা পৃথিবী। আমার পৃথিবীও মৃণালদা ছাড়া সম্পূর্ণ নয়।’

বলিউড তারকা মনোজ বাজপেয়ি লিখেছেন, ‘চলচ্চিত্রজগতে উনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। একজন কিংবদন্তি। একজন গল্পকার। আমাদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা।’

মৃণাল সেন ছিলেন বাম ঘরানার এক ব্যক্তিত্ব। আজীবন তিনি বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গতকাল তাঁর মৃত্যুর পর বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গভীর শোক জানিয়েছেন। বলেছেন, ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতীয় সংসদ রাজ্যসভার সদস্য। তিনি ছিলেন এই দেশ আর এই বিশ্বের মানবিক ও সমাজসচেতন ব্যক্তিত্ব।

মৃণাল সেনের জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর শহরে, ১৯২৩ সালের ১৪ মে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফরিদপুর শহরে। তাঁর মৃত্যুতে অবসান হলো বাংলা চলচ্চিত্রের একটি যুগের। সে যুগের শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক আর এই মৃণাল সেন।

এই গাড়িতেই মৃণাল সেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
এই গাড়িতেই মৃণাল সেনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

১৯৪৩ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনার সময় মৃণাল সেন চলে আসেন কলকাতায়। তারপর এখানের স্কটিশ চার্চ কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন পদার্থবিদ্যায়। দীর্ঘ ৪৭ বছর পর ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশে প্রথম পা রেখেছিলেন। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু এই দুবার সফরেও তিনি ফরিদপুরে যেতে পারেননি। তৃতীয়বার বাংলাদেশে গিয়ে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ফরিদপুরে। দেখেছিলেন তাঁর জন্মভিটে। মুগ্ধ হয়েছিলেন। আরও মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর জন্মভিটের মানুষের আতিথেয়তা পেয়ে। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী গীতা সেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মৃণাল সেন মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ান। ছুটেও গিয়েছিলেন বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত।

কবি জসীমউদ্‌দীনের সঙ্গে মৃণাল সেনের গভীর সম্পর্ক ছিল। মৃণাল সেন বলেছিলেন, তাঁর ছোট বোন রেবা ছিল তাঁদের পরিবারের সবচেয়ে আদরের। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সেই ছোট্ট বোনটি বাড়ির পুকুরের জলে ডুবে মারা যায়। তাঁকে সমাহিত করা হয় তাদের বাড়ির মাটিতেই। রেবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে তাঁদের গোটা পরিবার। ওই সময় কবি জসীমউদ্‌দীন রেবার উদ্দেশে একটি কবিতা লিখে তা তুলে দেন মৃণাল সেনের হাতে। বলে দেন, এটি তিনি কাউকে দেননি। ছাপাও হবে না। এটি যেন তিনি সংরক্ষণ করে রাখেন।

মৃণাল সেনের বাড়ির আশপাশে ভক্তরা। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি
মৃণাল সেনের বাড়ির আশপাশে ভক্তরা। ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

বহু নামী সিনেমা তৈরির কারিগর ছিলেন এই মৃণাল সেন। ১৮টি ছবির জন্য পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পেয়েছিলেন ১২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। মৃণাল সেন বাংলা, হিন্দি, ওডিশি ও তেলেগু ভাষায় ছবি নির্মাণ করেছেন। তাঁর প্রথম ছবি ছিল ‘রাতভোর’। নির্মিত হয় ১৯৫৫ সালে। এরপরের ছবি ‘ছিল নীল আকাশের নিচে’। তিনি ২৬টি ছবি নির্মাণ করেছেন। নির্মাণ করেছেন ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি আর চারটি প্রামাণ্য চিত্র। এই মৃণাল সেনকে নিয়েই কলকাতায় আবার পাঁচটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে।

মৃণাল সেনের নির্মিত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘কলকাতা ৭১’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘পদাতিক’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘মৃগয়া’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘তাহাদের কথা’, ‘কোরাস’, ‘ভুবন সোম’, ‘খারিজ’, ‘পরশুরাম’, ‘খন্দর’ ইত্যাদি। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। তাঁর নির্মিত ছবি মস্কো, বার্লিন, কান, শিকাগো, মন্ট্রিল, ভেনিস, কায়রো, চেকোশ্লোভাকিয়া, স্পেন, ইতালি, তিউনিসিয়া ও কলম্বোর চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়েছে। তিনি ভারতের বিনোদন জগতের সর্বোচ্চ সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারসহ (২০০৫) ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী (১৯৮১) পেয়েছেন। ফরাসি সরকারের দেওয়া ‘কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব আর্টস লেটারস’ সম্মানও পেয়েছেন।