আসামে বিজেপির সঙ্গ ছাড়ল অগপ

‘বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিলকে’ কেন্দ্র করে বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল আসাম গণ পরিষদ (অগপ)। ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুয়াহাটি সফরের চার দিনের মাথায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যটিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ভেঙে গেল।

গতকাল সোমবার দিল্লি থেকে গুয়াহাটি ফিরে বিজেপির সঙ্গ ছাড়ার ঘোষণা দেন অগপ সভাপতি অতুল বরা। দিল্লিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে দেখা করে তিনি গুয়াহাটি ফিরে আসেন।

বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে অগপ আসামে ভোটে লড়েছিল। রাজ্যে তারা সরকারেরও শরিক। ১২৬ সদস্যের আসাম বিধানসভায় অবশ্য বিজেপির সমর্থনে এখনো প্রয়োজনীয় বিধায়ক রয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, লোকসভা ভোটের আগে অগপের ওই সিদ্ধান্ত উত্তর–পূর্বাঞ্চলে বিজেপির জন্য বড় ধাক্কা।

শুক্রবার আসামের শিলচরে ভোট প্রচারে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, ভারতীয় সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করানো হবে। এই বিলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও শিখ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এদিকে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে যুগ্ম সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) প্রতিবেদন গতকাল ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পেশ করা হয়। তবে ওই প্রতিবেদন জেপিসির কোনো বিরোধী সদস্যের অনুমোদন পায়নি। আজ মঙ্গলবার সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের শেষ দিনে বিলটি পেশ করা হলেও লোকসভা ভোটের আগে তা পাস হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিরোধীরা ছাড়াও শাসক বিজেপির দুই শরিক শিব সেনা ও সংযুক্ত জনতা দল এই বিলের বিরোধিতা করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। শুধু আসামই নয়, মেঘালয় ও মিজোরাম সরকারও এই বিলের বিরোধী। দুই রাজ্যের বিধানসভায় এ নিয়ে প্রস্তাবও পাস করা হয়েছে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি আটকানোর সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে গতকাল দিল্লিতে রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন অতুল বরা। বৈঠকের পর অতুল বরা সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিলটি যাতে পাস করা না হয়, কেন্দ্রকে সেটা বোঝানোর শেষ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু রাজনাথ সিং স্পষ্ট করেই জানালেন, কাল (পড়ুন মঙ্গলবার) বিলটি পাস হবে। এরপর তো জোটে থাকার প্রশ্নই ওঠে না।’

আসামে বিজেপির জোট শরিক অগপ প্রথম থেকেই বিলটির বিরুদ্ধে। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও অগপ নেতা প্রফুল্লকুমার মহন্ত মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার এই উদ্যোগ আসাম চুক্তির বিরোধী। তাই এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।’

বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব অগপের সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘বাংলাদেশি মুসলিমদের নিরাপত্তা দিতেই রাজ্যে শুরু হয় উলঙ্গ নৃত্য। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করাতে চাইছে বিজেপি।

নাগরিকত্ব বিলকে কেন্দ্র করে আসাম উত্তাল ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আসামে অগপ, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)সহ প্রায় সব গণসংগঠন এই বিলের বিরোধিতায় এককাট্টা। আজ মঙ্গলবার আসাম বন্‌ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। সোমবার দিল্লিতে আসামের নাগরিকদের পক্ষ থেকে নগ্ন অবস্থায় বিক্ষোভ দেখানো হয়। তাঁরা ‘বাংলাদেশি ভারত ছাড়ো’ স্লোগান দিয়ে এই বিলের বিরোধিতা করেন। বন্‌ধে যাতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে, হিংসা না ছড়ায়, সে জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজ্য সরকারকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছে।

এই বিলের উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন ঘটিয়ে প্রতিবেশী তিন মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রের ‘অত্যাচারিত’ সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়া। ২০১৪ সালের লোকসভার ভোটের আগে বিজেপি এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তিন প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, খ্রিষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি ও শিখ সম্প্রদায়ের যাঁরা ‘অত্যাচার’ সইতে না পেরে ভারতে আশ্রয় নেবেন, টানা ছয় বছর বসবাসের পর তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। নাগরিকত্ব পেতে প্রয়োজনীয় নথি না থাকলেও চলবে। এই তিন দেশের সংখ্যালঘুরা যাতে ব্যাংকের হিসাব খুলতে পারেন, জীবিকা নির্বাহে ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারেন, স্কুল-কলেজে ভর্তি ও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎ​সা পেতে পারেন, সে জন্য বিভিন্ন রাজ্যের জেলা শাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আইন রূপায়িত হলে তাঁরা ভোটদানেরও অধিকারী হয়ে যাবেন। বর্তমান আইন আনুযায়ী নাগরিকত্ব পেতে গেলে ১২ বছর বসবাস করা জরুরি।

অগপের সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্ত নিয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, হিন্দু ও মুসলিম বাঙালি ভোটের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজেপি নাগরিকত্ব বিলের বিষয়টিকে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। যদিও বিজেপির চূড়ান্ত লক্ষ্য, এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গে দলের আসন বৃদ্ধি। এই ভাবনা মাথায় নিয়ে বিজেপি যখন মাঠে নেমেছে, বুঝে নিতে হবে অগপ জোট ছেড়ে গেলে নিজেদের লাভ-ক্ষতির হিসাবটাও বিজেপি করে রেখেছে।