ইভিএমের কারচুপি জানায় গোপীনাথ ও গৌরী খুন?

যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার বিশেষজ্ঞ সৈয়দ সুজা দাবি করেছেন, ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে গোপন প্রযুক্তির মাধ্যমে ইভিএমে কারচুপি করা হয়েছিল। ইভিএম ‘হ্যাক’ করে বদলে দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের ফলাফল। প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল বদলে দেওয়ার গোপন ঘটনা জেনে যাওয়াতেই খুন করা হয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা গোপীনাথ মুন্ডে ও সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে।

আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে জানানো হয়, গতকাল সোমবার লন্ডন থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে লাইভে আলোচনার সময় সৈয়দ সুজা এই দাবি করেন।

সুজা বলেন, যে বিশেষজ্ঞ দল ওই লোকসভা নির্বাচনে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে ইভিএম মেশিন সরবরাহ করেছিল, তিনি (সুজা) সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, ওই লাইভে প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ব্যবহার করা ইভিএম মেশিনে কীভাবে কারচুপি করা যায়, তাও করে দেখান সুজা।

ইউরোপের ইন্ডিয়ান জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন লন্ডনে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে ছিলেন কংগ্রেস নেতা কপিল সিবাল।

তবে সৈয়দ সুজার এই অভিযোগ ‘উসকানিমূলক’ বলে ভারতের নির্বাচন কমিশন উড়িয়ে দিয়েছে।

২০১৪ সালের ২৬ মে মোদি সরকারের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন গোপীনাথ মুন্ডে। এক সপ্তাহ পর ৩ জুন নয়াদিল্লির কাছে গাড়িচাপায় নিহত হন তিনি। সৈয়দ সুজার দাবি, নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের কারচুপির কথা ফাঁস করে দেবেন ভাবায় গোপীনাথকে হত্যা করা হয়েছিল।

সৈয়দ সুজা বলেন, শুধু গোপীনাথ মুন্ডে নন, তাঁর (সুজা) কাছ থেকে ইভিএম দুর্নীতির বিষয়টি জেনেছিলেন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। তিনিও বিষয়টি ফাঁস করে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। সেই প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তাঁর দেহ। এই হত্যাও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন মার্কিন এই সাইবার বিশেষজ্ঞ।

লন্ডন থেকে লাইভ সম্প্রচারে সুজা বলেন, ২০১৪ সালে উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট বিধানসভার নির্বাচনেও ইভিএম নিয়ে কারচুপি হয়েছিল। নিম্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গের মাধ্যমে ইভিএম মেশিনে কারচুপি করতে বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) সেলকে সাহায্য করেছিল রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস। তিনি বলেন, ইভিএমে কারচুপি করা যায় কি না, তা জানতে চেয়ে আম আদমি পার্টি, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুজা সাংবাদিকদের সামনে হাতে–কলমে দেখিয়ে দেন, কীভাবে ইভিএমের তথ্য বদলে দেওয়া হয়। তাঁর দাবি, ব্লুটুথ প্রযুক্তির মাধ্যমে ইভিএমের তথ্য বদলানো সম্ভব নয়। কিন্তু গ্রাফাইট দিয়ে তৈরি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ইভিএমের তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেইসে ঢুকে পড়া সম্ভব। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই ট্রান্সমিটারই ব্যবহার করা হয়েছিল।

ভারতের বেশ কয়েকজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন, কোনো তার বা ওয়্যার ছাড়া ইভিএমের ডেটাবেইসে অদলবদল ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু সৈয়দ সুজার দাবি, প্রায় সাত হার্টজের নিম্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করে ইভিএম ডেটাবেইসে ঢুকে পড়া সম্ভব। একমাত্র বিশেষ সামরিক প্রকল্পের ক্ষেত্রেই এই নিম্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুজার দাবি, বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছে এই যন্ত্র ছিল। সারা দেশের নয়টি জায়গা থেকে এই নিম্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ পাঠিয়ে ইভিএমের সমস্ত তথ্য বদলে দেওয়া হয়েছিল। যাঁরা এই কাজ করেছিলেন, তাঁরা নিজেরাও জানতেন না যে তাঁদের কাজে বদলে যাচ্ছে সমস্ত নির্বাচনী ডেটাবেইস।

সুজার এই সংবাদ সম্মেলনের প্রতিক্রিয়ায় বিবৃতি দিয়েছে ভারতের নির্বাচন কমিশন। কমিশন সুজার বক্তব্য উসকানিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছে। কমিশনের দাবি, ভারত ইলেকট্রনিকস লিমিটেড এবং ইলেকট্রনিক করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ইভিএম মেশিন বানায়। এ জন্য ২০১০ সালেই বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করা হয়েছে। সুজার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখছে কমিশন।

বিজেপি নেতা মুক্তার আব্বাস নকভি বলেন, নরেন্দ্র মোদিকে সরানোর জন্য কংগ্রেস সবকিছুই করতে পারে। সুজার সংবাদ সম্মেলন তারই প্রমাণ। তিনি এটিকে কংগ্রেসের হরর শো হিসেবে চিহ্নিত করেন।

কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটে বলেন, বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের সামনে তুলে ধরা হবে।

তদন্ত দাবি করলেন গোপীনাথের ভাইপো
সাইবার বিশেষজ্ঞ সৈয়দ সুজার সংবাদ সম্মেলনের পর গোপীনাথ মুন্ডের মৃত্যুর তদন্ত দাবি করেছেন তাঁর ভাইপো এনসিপি নেতা ধনঞ্জয় মুন্ডে। টুইটে তাঁর দাবি, ‘র’ বা সুপ্রিম কোর্ট যেন এই তদন্ত করেন।

ধনঞ্জয় বলেন, ‘যাঁরা গোপীনাথ মুন্ডেকে ভালোবাসতেন, কাকার মৃত্যু নিয়ে তাঁদের মধ্যে একটা সন্দেহ রয়েই গিয়েছে। ওটা কি আদৌ কোনো দুর্ঘটনা ছিল, নাকি ষড়যন্ত্র, তাঁরা এই প্রশ্ন তুলেছেন বারবার।’ সাইবার বিশেষজ্ঞ সুজার দাবির পর কাকার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ আরও তীব্র হলো বলে জানান ধনঞ্জয়। টুইটে তিনি বলেন, ‘ইভিএম হ্যাকের দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে বড় বিপজ্জনক আভাস!’