গরু তাড়াতে কৃষক মরিয়া

গোরক্ষায় তৈরি হয়েছে গোশালা। ছবি: রয়টার্স
গোরক্ষায় তৈরি হয়েছে গোশালা। ছবি: রয়টার্স

এর আগে কখনোই খেত পাহারা দিতে রাত জাগতে হয়নি গোপীচাঁদ যাদবকে। তবে এবার যতই তাঁর সরষেখেতের ফুল হলুদ হয়ে আসছিল, ততই দুশ্চিন্তায় চোখে সরষে ফুল দেখছিলেন তিনি। নিরুপায় হয়ে খেতের পাশে কোনো রকম একটি ছাউনি তুলেই রাত থাকতে শুরু করেন যাদব। কনকনে ঠান্ডায় রাতে ঘুম হয় না বললেই চলে, তার ওপর সারা রাত সজাগ থাকতে হয়। এত কষ্ট করে যদি ‘ভবঘুরে’ পশুগুলোর হাত থেকে ফসল বাঁচানো যায়, তাহলে হয়তো মনে কিছুটা শান্তি আসে।

‘ভবঘুরে’ এই পশু কারা? এ প্রশ্নের উত্তর বর্তমান ভারতীয় ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে দেওয়া খুব বেশি কঠিন নয়। গরু তাড়ানোর জন্যই রাতভর জেগে থাকতে হয় যাদবের মতো ভারতীয় কৃষকদের। যাদবের মতো হাজারো কৃষকের এই কনকনে ঠান্ডায় এখন রাত কাটে খেতের পাশের কুঁড়েতে। রাস্তায় ফেলে যাওয়া মানুষের ক্ষুধার্ত গরু যেন ফসল খেয়ে না ফেলে, তাই তাঁদের ঘুমের মধ্যেই হাতে লাঠি নিয়ে থাকতে হয় সতর্ক। অথচ এত কষ্টের ফসলের দামও নেই খুব বেশি।

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। মোদি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার পরপরই গরু বিক্রি নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক। দুধ দেওয়ার ক্ষমতা হারানো বয়স্ক গাভি নিয়ে বিপাকে পড়েন খামারিরা। খাওয়াতে ব্যয় করতে হয়, অথচ আয় নেই। অনেক খামারি তাই চুপিচুপি রাস্তায় ছেড়ে আসেন অনুৎপাদনশীল গাভি ও বলদ। রাস্তায় থাকা এসব পশু খাবারের খোঁজে হানা দেয় কৃষকদের জমিতে। নষ্ট করে ফসল। ধারদেনা করে চাষ করেন কৃষকেরা। খেতের ফসল নষ্ট হলে নিরুপায় হয়ে পড়েন তাঁরা।

কৃষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এসব ভবঘুরে গরুর সংখ্যা এতই বেড়েছে যে তাঁদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় কারণে গোহত্যা নিষিদ্ধ হলেও হিন্দু কৃষকেরাই এখন অসন্তুষ্ট, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তাঁরা। সরকারের এহেন কর্মকাণ্ডে অন্য কৃষকদের মতোই মহা বিরক্ত নয়াদিল্লি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম কাকরিপুরের এক কৃষক বাবুরাও সাইনি। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই সমস্যায় জর্জরিত আমরা, তারপর সরকার আরও সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এই প্রথম ফসল বাঁচাতে খেতের পাশে থাকতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।’

মোদি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার পরপরই গরু বিক্রি নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক। ছবি: রয়টার্স
মোদি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসার পরপরই গরু বিক্রি নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক। ছবি: রয়টার্স

গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মুনিদেব তিয়ারি নামের ওই কৃষক ধান, ভুট্টা ও ডাল উৎপাদন করেন। রাত হলে পাহারাদার হয়ে যান তিনি। উত্তর প্রদেশের শাহিবপুর গ্রামের ওই কৃষক রাতে দুই ঘণ্টাও ঘুমাতে পারেন না। আগের মৌসুমের ফসল নষ্ট করেছিল গরু। খুব কষ্টে কেটেছে তাঁর বছরটা।

গত নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান মোদি। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্রের ৮০টি আসনের মধ্যে ৭৩টি আসন জিতেছিল এই সরকার। গ্রামীণ এই ভোটাররা উচ্চ ফসলের দামের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। এ ছাড়া হিন্দু কৃষকেরা সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে উত্তেজনার কারণে বিজেপিকেই সমর্থন করেছিল। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদির জয় নিয়ে বেশ সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। গত ডিসেম্বরে রাজ্যসভা নির্বাচনে উত্তরাঞ্চলের তিন প্রদেশে কংগ্রেসের জয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে মোদি সরকারের। ২৬ কোটি ৩০ লাখ কৃষকের সমর্থন ফিরে পেতে কঠোর চেষ্টা করছেন মোদি। বার্তা সংস্থা রয়টার্স মহাবন গ্রামের অন্তত ৫০ জন কৃষক ও উত্তর প্রদেশের তিন গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছে, এবারে মোদি সরকারকে ভোট দিতে তাঁরা দুবার ভাববেন।

কৃষকেরা সাধারণত গরু থেকে দুধ উৎপাদন করেন। সেই দুধ থেকে পনির এবং মাখনও উৎপাদন করেন। তবে গোহত্যা, বিশেষ করে খাদ্যের জন্য গোহত্যা হিন্দুধর্মে নিষিদ্ধ বলে মনে করা হয়। এর আগে এই বিষয়ে খুব বেশি কড়াকড়ি ছিল না। তবে মোদি সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাতারাতি পাল্টে যায় চিত্র। গরু রক্ষার নামে প্রাণ গিয়েছে অনেক মানুষের। কৃষকেরা বলছেন, গরু তাঁদের জন্য পবিত্র—এটা ঠিক। তবে গবাদিপশু বাণিজ্য হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা গ্রামীণ অর্থনীতিতে আঘাত হানছে। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের উচিত আরও বেশি গো-আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা। গরু ব্যবসায়ীদের অন্য পশু বাণিজ্যে উৎসাহিত করা।

গরু কল্যাণ কর্মসূচিতে সাড়ে সাত বিলিয়ন রুপি বাজেট ধরা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
গরু কল্যাণ কর্মসূচিতে সাড়ে সাত বিলিয়ন রুপি বাজেট ধরা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, গত কয়েক বছরে ভারতের মাংস ও চামড়া রপ্তানির পরিমাণ অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। শুধু তা-ই নয়, নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পশুর ওষুধ, বোতাম, রঙের ব্রাশ, টুথপেস্টসহ অনেক শিল্পে, যেগুলোর মূল উপাদান হিসেবে পশুর হাড়ের ব্যবহার করা হতো। ভারত ছিল বিশ্বের প্রধান মাংস রপ্তানিকারক দেশ। এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে ব্রাজিল। এর মধ্যে ছেড়ে দেওয়া গরুর হামলায় নষ্ট হতো শত শত হেক্টর জমির ফসল।

মনোহরপুরের কৃষক রাজেশ পালোয়ান বলেন, গত বছরের চেয়ে গবাদিপশুর খাবারের দাম এক-তৃতীয়াংশ বেশি বেড়েছে এবং দুধ উৎপাদন বন্ধ করার পরে অধিকাংশ কৃষক আর গরু পালতে পারেন না। ভারত, বিশ্বের বৃহত্তম দুধ উৎপাদক দেশ। প্রতিবছর প্রায় এখানে ৩০ লাখ গবাদিপশু অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে। আগে হিন্দু কৃষকেরা অনুৎপাদনশীল গরু মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন। প্রায় ২০ লাখ গরু বাংলাদেশে পাচার হয়ে যেত। তবে এখন সে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ২০টি রাজ্যে গরু ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।

এখন বেশির ভাগ মানুষই এসব গরু রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসে। প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই এসব গরুর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করেনি। তবে ভোট পেতে মরিয়া সরকার অন্তর্বর্তী বাজেটে সরকার কিছুটা অর্থায়ন দিয়েছে। গরু কল্যাণ কর্মসূচিতে সাড়ে সাত বিলিয়ন রুপি বাজেট ধরা হয়েছে।

‘ভবঘুরে’ গরু নিয়ে বিড়ম্বনায় মানুষ। ছবি: রয়টার্স
‘ভবঘুরে’ গরু নিয়ে বিড়ম্বনায় মানুষ। ছবি: রয়টার্স

অল ইন্ডিয়া মিট অ্যান্ড লাইভ স্টক এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাউজান আলভি বলেন, ‘গবাদিপশুদের পুনর্বাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। গরু তো বাদ, আমরা এমনকি অন্য কোনো পশু আত্মীয়স্বজনের কাছেও বিক্রি করতে পারি না। গরু নজরদারি কমিটির সদস্যেরা সব সময় সক্রিয়।’

আসলে ভারতের ৮৫ শতাংশ কৃষকের হাতে দুই হেক্টরের বেশি জমি নেই। তাই ফসলের অল্প অংশ নষ্ট হলেও তা তাঁদের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনে।

একটা ঘটনার কথা তুলে ধরা যাক। বিনা মূল্যে গরুর খাবার দেওয়া হবে—২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এমন ঘোষণা দেয় উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ডের স্থানীয় এক কলেজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ ঘোষণা দিয়ে কেবল একটা পোস্ট দেওয়া হয়। তিন শর মতো গরুকে খাওয়ানোর ইচ্ছে ছিল কর্তৃপক্ষের। তবে ঘটনার দিন এক এলাহি কাণ্ড। বিভিন্ন এলাকা থেকে খামারিরা নিয়ে আসেন সাত হাজার গরু। আরও ১৫ হাজার গরু নিয়ে আসা খামারিদের রীতিমতো মারধর করে বিদায় করে পুলিশ ও কলেজের কর্মচারীরা। হুড়োহুড়ি আর হাতাহাতিতে মারা যায় কয়েকজন। ওই জায়গায়ই আত্মহত্যা করেন উত্তর প্রদেশের এক কৃষক। হতভাগ্য ওই কৃষকের অভিযোগ ছিল, মানুষের ফেলে যাওয়া গরু তাঁর খেতের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। দুই লাখ রুপি ধার করে আবাদ করেছিলেন। কিন্তু এখন খাবার নেই, কিন্তু রয়েছে ঋণের খড়্গ। সেই কষ্টেই দুনিয়া ছাড়লেন তিনি।