মোদির 'সবার বিকাশ' কেমন জানতে চায় নাহিদ কলোনি

বেগম তাবাসুম হাসান ও  প্রদীপ চৌধুরী
বেগম তাবাসুম হাসান ও প্রদীপ চৌধুরী
>

• মুজফফরনগরের দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত চার শ হতদরিদ্র মুসলিমের আশ্রয় নাহিদ কলোনি
• কোনো সুবিধাই নেই সেখানে
• নাহিদ হাসান সমাজবাদী পার্টির টিকিটে জেতা এমএলএ

‘কৈরানা এসেছেন যখন, অবশ্যই একবার নাহিদ কলোনিটা ঘুরে আসবেন। মুজফফরনগরের দাঙ্গায় সর্বস্বান্ত মুসলমানেরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছে, সেটা একবার দেখা দরকার। না হলে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’–এর (সবাইকে নিয়ে সবার উন্নতি) ছবিটা বুঝবেন কী করে?’

কথাটা কৈরানা শহরের একটি রেস্তোরাঁর মালিক মহম্মদ মুস্তাকিনের। প্রায় একনিশ্বাসে কথাটা বলে জানালেন, নাহিদ নামে ওই মানুষটির মা বেগম তবাসুম হাসান এবারও এই লোকসভা আসনে বিজেপির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন। তিনি জোট প্রার্থী। এবারও তাঁর জয় নাকি স্রেফ ঘোষণার অপেক্ষা।

উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশের মোট ১১ লোকসভা আসনের মধ্যে যে ৮টির ভোট হতে চলেছে ১১ এপ্রিল, কৈরানা তার একটি। শামলি জেলার বড় শহর কৈরানার নাম সর্বজনীন হয়ে ওঠে মুজফফরনগরের দাঙ্গার পর। শয়ে শয়ে মুসলমান যখন মুজফফরনগর থেকে কৈরানা শহরে প্রাণ বাঁচাতে চলে এসেছে, তখন পাল্টা মার খেয়ে কয়েক শ হিন্দু পরিবার চলে যায় শামলি জেলার নিরাপদ জায়গাগুলোয়। গৃহত্যাগী হিন্দু–মুসলমানেরা আজও নিজভূমে পরদেশি। পুনর্বাসনের কোনো সরকারি উদ্যোগ কেউ কিন্তু এখনো দেখেনি।

দাঙ্গাটা ছিল ২০১৩ সালের ঘটনা। কৈরানা কিন্তু ফের একবার দেশের রাজনৈতিক ম্যাপে চলে আসে গত বছর। বিজেপির সাংসদ হুকুম সিংয়ের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনের সময়। তত দিনে বিজেপিকে রুখতে জোটবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তা বুঝে গেছেন সমাজবাদী অখিলেশ ও দলিত নেত্রী মায়াবতী। গোরক্ষপুর ও ফুলপুরের সঙ্গে কৈরানার উপনির্বাচনেও বিজেপির বিরুদ্ধে সম্মিলিত জোট প্রার্থী দাঁড় করিয়ে উত্তর প্রদেশের ‘ফুফু–ভাতিজা’ জুটি লোকসভা নির্বাচনের ‘থিম সং’য়ের সুর বেঁধে দিয়েছেন। তিন কেন্দ্রে বিজেপির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আঁকা হয় উত্তর প্রদেশের নতুন রাজনৈতিক চালচিত্র। প্রয়াত হুকুম সিংয়ের কন্যা মৃগাঙ্গাকে প্রায় ৫০ হাজার ভোটে হারিয়ে চাঞ্চল্য ফেলে দেন তবাসুম হাসান। সেবার তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় লোকদলের প্রার্থী। এবারও তাই। তবে লড়ছেন সমাজবাদী পার্টির প্রতীক সাইকেল নিয়ে।

এক বছরের মধ্যে এই তল্লাটে এমন কিছু ঘটেনি, যাতে জোট প্রার্থী তবাসুমকে হারিয়ে বিজেপির প্রদীপ চৌধুরী বাজি মাত করতে পারেন। অবশ্য একেবারেই যে কিছু ঘটেনি তা নয়। এই কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী করেছে হরেন্দ্র সিং মালিককে। প্রতীকী নয়, রীতিমতো অঙ্ক কষে তারা প্রার্থী করেছে জাট হরেন্দ্র সিং মালিককে। দাঙ্গার জন্য জাট–মুসলমান সম্পর্ক সাপে–নেউলের। জাটেরা তবাসুমকে ভোট না দিলে সেই সমর্থন যাতে বিজেপিতে চলে না যায়, তা নিশ্চিত করাই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য। বহিরাগত প্রদীপ জাতে গুজ্জর। মানে গোয়ালা। তাঁর মনোনয়নে জাট মৃগাঙ্গা ক্ষুব্ধ। উপনির্বাচনে হারলেও এবারও তিনি ছিলেন দাবিদার। টিকিট না পেয়ে মন খারাপ করে মৃগাঙ্গা খিল দিয়েছেন গোসসা ঘরে। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, তলে তলে তিনি নাকি প্রদীপের পায়ের তলার মাটি ঝুরঝুরে করে দেওয়ার খেলা খেলছেন। জাট সমর্থন কংগ্রেসে পাঠানোর খেলা। এই উপমহাদেশে আজও অনেকের কাছে দেশের চেয়ে দল ও দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বড়। মৃগাঙ্গার বিরুদ্ধে অভিযোগও তেমনই।

তবাসুম তাই নিশ্চিন্ত। তাঁরই ছেলে নাহিদ হাসান। উত্তর প্রদেশের কৈরানা বিধানসভা আসনে সমাজবাদী পার্টির টিকিটে জেতা এমএলএ। মুজফফরনগরের চার শ হতদরিদ্র মুসলমান পরিবারের ত্রাতা।

কৈরানা শহর থেকে নাহিদ কলোনি ১০ মিনিটের পথ। ঝিনঝানা হয়ে যে পাকা রাস্তা সাহারানপুর চলে গেছে, তার দুধারে আদিগন্ত বিস্তৃত আখ ও গমখেতের মাঝে মাঝে আমের বাগান। সাড়ে বাইশ বিঘা জমির ওপর এমনই এক ছায়া ছায়া আমবাগান সাফ করে পাঁচ বছর আগে নাহিদ থাকতে দেন ওই চার শ পরিবারকে। সেই থেকে জায়গাটার নাম হয়ে গেছে নাহিদ কলোনি।

তবে নামেই কলোনি। পাকা দালান একটাই। দেওবন্দের মাওলানা কলোনিতে একটা মসজিদ তৈরি করে দিয়েছেন। তার কোল ঘেঁষে এক কাতারে একতলা এক সারি পাকা ঘর। সেই ঘরগুলোর সামনে যত দূর চোখ যায় ঝুপড়ি আর ঝুপড়ি। বাঁশের ছাউনির মাথায় পলিথিনের চাদর বিছানো। তার ছাদে হোগলার পাতা ডাং করে রাখা, যাতে ঝড়ে ঘরের চাল উড়ে না যায়। আব্রু ঢাকছে শুকনো কঞ্চির বেড়া। মাটি কুপিয়ে গর্ত করে কাপড় ঘেরা পায়খানা। দুর্গন্ধে টেকা দায়। ভনভন করছে মাছি, গুনগুন করছে মশা। সেসব উপেক্ষা করে চোর–পুলিশ খেলছে বাচ্চারা। নাহিদ নিজের গরজে নলকূপ করে দিয়েছেন গোটা তিনেক। হাজার দুয়েক মানুষের প্রয়োজন ওগুলোই মেটায়। পেট চালানো বড় দায়। অধিকাংশের কাজ মজদুরি। কেউ জমির মুনিষ। কেউ শহরের মজদুর। কেউ ইটভাটার। দু–একজন কীভাবে কে জানে ব্যাটারি রিকশা কিনেছে। কিছু রোজগার সেখান থেকে হয়। বাকিরা পশু পালে। খুঁটিতে বাঁধা ছাগল প্রায় ঘরে ঘরে। কাঁঠালপাতা তাদের একমাত্র খাদ্য। রয়েছে কিছু গরুও। সরকারি রেশন মেলে মাসে দুবার। নাহিদের গরজে বছর তিনেক হলো কলোনিতে বিদ্যুৎ এসেছে। কিছু ঘরের চালে দেখা গেল ডিশ টিভি। একমাত্র বিনোদন।

স্কুল আছে? ইসলামুদ্দিনের তাচ্ছিল্যের চাহনি বুঝিয়ে দিল প্রশ্নটা করাই উচিত হয়নি। ছয় ছেলে তিন মেয়ের বাপ ইটভাটার মজদুর ইসলামুদ্দিন খুঁটিতে ছাগল বাঁধতে বাঁধতে বললেন, স্কুল নেই। হাসপাতালও নেই। অসুখ–বিসুখ হলে কৈরানা। স্কুলে পড়াতে হলেও কৈরানা। আমাদের ছেলেপিলেরা ভাগ্যবান। মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে তারা দুবেলা বিনি পয়সায় পড়ে। কী পড়ে তারাই জানে। আমরা জানি, পড়লেও কোনো লাভ নেই। চাকরি–বাকরি আমাদের কপালে নেই।

মহম্মদ মুস্তাকিন নাহিদ কলোনি ঘুরে দেখতে বলেছিলেন। সেই কলোনির ইসলামুদ্দিন, ইরশাদ ও জাহাঙ্গীরেরা শুধু একটা কথাই জানতে চাইলেন, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ থেকে আমরা বাদ কেন বলতে পারেন? মোদিজি কিংবা যোগীজিকে (উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ) কি এই কথাটা বলা যায়, পাঁচ বছরেও আমাদের জন্য সরকার একটা টাকাও কেন খরচ করল না?’

প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই। আকাঙ্ক্ষা আছে, স্বপ্ন নেই। নাহিদ কলোনির উদ্বাস্তুদের ভোট আছে, প্রত্যাশা নেই। নাহিদ ছাড়া তাঁরা আর কাউকে চেনেনও না।