জাপানে আত্মহত্যা কমছে যেভাবে

মার্চ মাস। শীতের রাত। ঘুম ভেঙে গেল তায়েকো ওয়াতানাবের। রক্তের লম্বা একটা দাগ নজর কাড়ল তাঁর। ছেলে ইউকির বিছানায় একটা রক্তমাখা চাপাতি। ঘরে ছেলে নেই। বাধ্য হয়ে পুলিশে ফোন করলেন। পুলিশ এসে তাঁর শোবার ঘর থেকে উদ্ধার করল আত্মহত্যাবিষয়ক চিরকুট।

এই আত্মহত্যার ঘটনা ২০০৮ সালের। ছেলের ঘরে তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পুরোনো সেই মর্মান্তিক ঘটনা এভাবে বর্ণনা করছিলেন তায়েকো ওয়াতানাবে। গত ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি। জাপানের আকিতায় তাঁর বাড়ি।
ইউকির ফুল ও ফুজি আপেলের বাগানে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল ছবি হাতে রয়টার্সকে ওয়াতানাবে বলেন, ‘আমার ছেলের লাশ ওরা (পুলিশ) মন্দিরের পাশে একটি খালে পড়ে থাকতে দেখে। তারপর লাশটা কম্বলে মুড়ে নিয়ে যায়। ময়নাতদন্তের পর ছেলের লাশ বাড়ি ফিরে আসে। আর আমি একেবারে একলা হয়ে পড়ি।’
ইউকি মারা যান ২৯ বছর বয়সে। টোকিও থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আকিতা এখনো জাপানের অন্যতম আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকা। প্রায় দুই দশক ধরে আত্মহত্যার জন্য আকিতা শীর্ষস্থানে রয়েছে।

তবে হালে এই পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে বলে জানান ওয়াতানাবে। তাঁর মতে, এখন যদি ইউকি একই রকম পরিস্থিতিতে পড়ত, তাহলে হয়তো সে আত্মহত্যা করত না। ছেলের মৃত্যুর পর ওয়াতানাবে নিজেও আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন। কিন্তু এখন নিজেই একটা ‘সুইসাইড সারভাইভরস গ্রুপ’ পরিচালনা করেন। এই গ্রুপটি জাতীয়ভাবে পরিচালিত একটি প্রকল্পের অংশ, যা গত ১৫ বছরে আত্মহত্যার হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পেরেছে, যা সরকারের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকেও বেশ কম। গত ৪০ বছরের ভেতর আকিতায় আত্মহত্যার হার এখন সবচেয়ে কম।

২০০৭ সালে জাপান সরকার আত্মহত্যা প্রতিরোধ কর্মসূচি হাতে নেয়। ২০১৬ সালে এই কর্মসূচি আরও নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে বড় আকারে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ শুরু করে। কারখানাগুলোতে কর্মচারীরা কী পরিমাণ কাজের চাপে রয়েছেন, প্রতিবছর তা পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক বলেও ঘোষণা করেছে সরকার।

লজ্জা বা অসম্মান ঢাকার উপায় হিসেবে অনেক দিন ধরে জাপানিরা আত্মহত্যা নামক ভুল সমাধানের কাছে গেছে। মানসিক ভারসাম্যহীনতাও নাকি শেষ হয়েছে আত্মহত্যার কাছে এসে। আবার একাকিত্বে ভুগে অনেকে সঙ্গী করেছেন আত্মহত্যাকেই। হিরোকি কোসেকি নামক আত্মহত্যা প্রতিরোধ কর্মীর মতে, ‘অনেক দিন ধরে ভাবা হতো, আত্মহত্যা একটি ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে জাপান সরকারের কোনো ভূমিকা নেই।’
আকিতায় আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে বেকারত্ব, দীর্ঘ শীতকালের পীড়ন, নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকাল বা দেনার দায় উল্লেখযোগ্য। মূল শহরগুলো থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন ও দুর্গম হওয়াও একটা কারণ, যা আকিতাকে আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকাগুলোর তালিকার শীর্ষে নিয়ে গেছে।

১৯৯৯ সালে আকিতার গভর্নর জাপানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখে। মাত্র ৯ লাখ ৮১ হাজার মানুষের এই শহর থেকেই সবচেয়ে বেশি মানুষ জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ দলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে। জাপানের আত্মহত্যা প্রতিবিধান সহায়তা কেন্দ্রের পরিচালক ইউতাকা মোতোহাশি বলেন, ‘যেহেতু এটা (আত্মহত্যা) একটা ব্যক্তিগত সমস্যা, তাই জাপান সরকারও জনগণের করের টাকা এই খাতে খরচ করতে চায়নি। কিন্তু আকিতা নিজের এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এই প্রকল্প চালু করল। একসময় সমগ্র জাপান তা অনুসরণ করে।’ মোতোহাশি ১৯৯০-এর দশকে আত্মহত্যাপ্রবণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করেছেন।

আকিতায় যখন হতাশা বাড়তে থাকে, তখন যেসব আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা হয়। হিসাও সাতো (৭৫) তাঁদেরই একজন। ২০০০ সালে তাঁর ব্যবসায় ভরাডুবি হয়। ওই সময় তিনি তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে সেতুর ওপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে দেখেন। এতে প্রভাবিত হয়ে ভাবেন, আত্মহত্যাই সব সমস্যার সমাধান। অচিরেই তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। ২০০২ সালে তিনি একটি সংগঠন চালু করেন, এটি আইনজীবী এবং অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত। তাঁরা আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। আকিতা সরকার এই সংগঠনের প্রায় ৬০ শতাংশ খরচ বহন করে। আর বাকিটা আসে অনুদান থেকে।

জাপানি সংসদের নিম্নকক্ষে সাতোর মতো এ ধরনের সংগঠন চালু করার জন্য আইন পাস করার প্রক্রিয়া চলছে। সাতোর মতে, একটা মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক ধস নামা কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি মানবিক সমস্যাও বটে।

‘গেটকিপার’ নামে আকিতায় এ ধরনের আরও একটি সংগঠন রয়েছে। মোতোহিশোর মতে, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা কেবল সাংগঠনিক দায়িত্ব নয়, এটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দায়িত্ব।
জাপান সরকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এই প্রকল্প আকিতায় চালু হয়। আকিতার তিন হাজার মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের লক্ষ্য, ২০২২ সালের মধ্যে ১০ হাজার মানুষকে বা প্রতি ১০০ জনের ১ জন মানুষকে এই প্রশিক্ষণের আওতায় আনা। এর উদ্দেশ্য আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা ও মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন করা।

সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিভিন্ন সংগঠন ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার দেশ’ হওয়ার কলঙ্ক মুছতে উঠেপড়ে লেগেছে জাপান সরকার। এই যাত্রার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো, আত্মহত্যাকে ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে না দেখে একটা জাতীয় সংকট হিসেবে বিবেচনা করা। যখন থেকে পরিসংখ্যান আর হিসাবনিকাশের ঊর্ধ্বে উঠে আত্মহত্যাকে মানবিক সমস্যা হিসেবে দেখা শুরু হয়েছে, সেই দিন থেকেই আত্মহত্যার হার অবিশ্বাস্যরকমভাবে কমতে শুরু করেছে জাপানে!