ছাড়ের রাজনীতিতে ব্যতিক্রম আমেথি

>

• লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
• বহু বছর আমেথি ও রায়বেরিলিতে লোকসভা ভোটে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি প্রার্থী দেয় না
• আজমগড়ে জোট প্রার্থী অখিলেশ যাদব
• কংগ্রেস প্রার্থী দেয়নি
• বারানসিতে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে শক্ত কোনো প্রার্থী নেই
• মুলায়ম সিং যাদব প্রার্থী হয়েছেন মৈনপুরী থেকে

তাপমাত্রা ৪৩ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু যে রাজ্যকে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলে ডাকা হয়, ভারতের সেই উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌয়ে ভোটের এই ভরা মৌসুমে তাপমান সাধারণত ১০০ ডিগ্রিতে পৌঁছানোর কথা! কিন্তু সেই উত্তাপ অনুভূত নয় কেন?

এর জবাব খুঁজতে গেলে ভারতের ভোটের রাজনীতির চিরকালীন সংস্কৃতির একটু চর্চা প্রয়োজন। কবে থেকে যে এই সংস্কৃতির শুরু, তা বলা খুবই কঠিন। স্বচক্ষে দেখা, চন্দ্রশেখরের মতো রাজনৈতিক নেতাকে, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে যিনি ‘তরুণ তুর্কি’ উপাধি পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হন তিনি। সেই চন্দ্রশেখর যখন নখদন্তহীন সিংহে পরিণত, নিজের খাসতালুক উত্তর প্রদেশের পূর্ব প্রান্তের বালিয়াতে প্রায় প্রভাব ও প্রতাপহীন, তখনো তিনি লোকসভার ভোটে দিব্যি জিতে যাচ্ছেন। অনেক পরে বোধগম্য হয়েছিল, ভারতীয় রাজনীতিতে মারকাটারি সম্পর্কের পাশাপাশি কৃতজ্ঞতাবোধও প্রবলভাবে সচল। চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে তাই তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা জোরালো কোনো প্রার্থী কখনো দাঁড় করাননি।

দীর্ঘদিনের সফল, জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী নেতারা এই ব্যতিক্রমী ব্যবহারটুকু আজও যে পেয়ে চলেছেন, উত্তর প্রদেশের রাজনীতির এটা একটা অদ্ভুত বিস্ময়। আজ বহু বছর আমেথি ও রায়বেরিলিতে লোকসভা ভোটে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি প্রার্থী দেয় না। এই যে এবার, মহাজোট তৈরি নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে বহুজন সমাজের তুলকালাম হয়ে গেল, মায়াবতী উঠতে-বসতে কংগ্রেসকে গালমন্দ করছেন, অসন্তোষ প্রকাশ করছেন অখিলেশও, তাঁরাও কিন্তু এই দুই আসন ছেড়ে রেখেছেন। প্রতিদান কংগ্রেসও যে দিচ্ছে না, তা নয়। আজমগড়ে এবার জোট প্রার্থী অখিলেশ যাদব। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস এত গন্ডা প্রার্থী দিলেও আজমগড়ে কাউকে দাঁড় করায়নি। মহাজোটের সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্কের সময় বিজেপিও আজমগড়ে দাঁড় করাল এমন একজনকে, যিনি আদৌ কোনো সিরিয়াস রাজনৈতিক প্রার্থীই নন। এখানে বিজেপির প্রার্থী ভোজপুরি চলচ্চিত্রের অভিনেতা দীনেশ লাল যাদব। প্রতিদানের উদাহরণও রয়েছে প্রবলভাবে। বারানসিতে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কোনো দলই কিন্তু শক্ত কাউকে দাঁড় করাল না। ‘প্রিয়াঙ্কা প্রিয়াঙ্কা’ রব অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে গেল। কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন সেই অজয় রাই, গত লোকসভা নির্বাচনে যিনি তৃতীয় স্থান পেয়েছিলেন। সমাজবাদী পার্টি প্রার্থী করল এমন একজনকে, যিনি প্রার্থী পদ ঘোষণার দিনই কংগ্রেস ছেড়ে অখিলেশের দলে যোগ দিয়েছেন।

এই রাজ্যের মৈনপুরী থেকে সম্ভবত জীবনের শেষ লোকসভার ভোটে লড়ছেন অখিলেশের বাবা মুলায়ম সিং যাদব। বারবার তিনি ‘এই শেষবার’ লড়াইয়ের কথা জানিয়ে দিচ্ছেন। মায়াবতী নিজে মৈনপুরী গিয়ে মুলায়মের পাশে বসে তাঁর গুণগান করেছেন। প্রবীণ মুলায়মকে সম্মান দেখাতে বিজেপি দাঁড় করিয়েছে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীকে, কংগ্রেস প্রার্থীই দেয়নি।

ব্যতিক্রমী আসন একটাই, আমেথি। রাহুল গান্ধীকে এবার এই কেন্দ্রে হারাতে বিজেপি শিষ্টাচারের কোনো ধার ধারছে না। এখানে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন স্মৃতি ইরানি। আগের লোকসভা নির্বাচনেও এই আসনে তিনি বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে রাহুলের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। এবার আরও জোরেসোরে নেমেছেন প্রচারণায়। বিজেপির সভাপতি অমিত শাহও আমেথিতে গিয়েছিলেন তাঁর জন্য প্রচারণায়।

রাজ্যের রাজধানী লক্ষ্ণৌয়ে সেই কবে থেকে বিজেপির ট্যাঁকে গোঁজা। অটল বিহারি বাজপেয়ি পাঁচ-পাঁচবার এই আসন থেকে জিতেছেন। শহরবাসীর কাছে তাঁর টানই ছিল আলাদা। তারপরও স্থানীয় বিজেপির নেতারা কেন্দ্রটিকে হাতছাড়া করেননি। গতবার রাজনাথ সিং জিতেছিলেন। এবারও তিনিই প্রার্থী। তাঁর প্রতিও দেখা যাচ্ছে প্রতিপক্ষরা সংস্কৃতি মেনে সদয়।

কংগ্রেস এই আসনে যাঁকে টিকিট দিয়েছে, তিনি এই রাজ্যের সম্বল আসনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে চতুর্থ স্থানে ছিলেন। নাম আচার্য প্রমোদ কৃষ্ণম। এবারের প্রচারণায় জনসভায় দাঁড়িয়ে এক নিশ্বাসে জয় শ্রীরাম ও আল্লাহু আকবর বলতে দ্বিধা করছেন না। দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলছেন, ‘হিন্দু ও মুসলমান সবাই আমাকে ভোটে দেবে। কারণ, আমি ধর্মের পথে আছি। কোনো ধর্মই অন্যকে অশ্রদ্ধা করতে শেখায় না।’

অখিলেশ-মায়াবতীর জোট টিকিট দিয়েছে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া শত্রুঘ্ন সিনহার স্ত্রী পুনমকে। শত্রুঘ্ন জানেন, পুনমও জানেন, লক্ষ্ণৌবাসীরাও জানেন, রাজনাথ সিংয়ের জয় স্রেফ ঘোষণার অপেক্ষায়। বহু বছর এতটা একপেশে ভোট লক্ষ্ণৌয়ে হয়নি। এসব ছাড়ের কারণে লড়াই সত্ত্বেও লক্ষ্ণৌয়ের তাপমান তীব্রতর হয়ে উঠতে পারল না।