'ব্র্যান্ড মোদি' কি পরীক্ষায় উতরাবে?

হরিয়ানায় নির্বাচনী প্রচারণা নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপির পক্ষ থেকে স্মারক উপহার দেওয়া হয়। ভারত, ০৮ মে। ছবি: টুইটার
হরিয়ানায় নির্বাচনী প্রচারণা নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপির পক্ষ থেকে স্মারক উপহার দেওয়া হয়। ভারত, ০৮ মে। ছবি: টুইটার

পাঁচ বছর আগেও তিনি ব্র্যান্ড হয়ে ওঠেননি, তাই ভারতীয় জনতা পার্টি অথবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের কথা তাঁর মুখে সব সময় শোনা যেত। শোনা যেত অটল বিহারি বাজপেয়ির নামও। পাঁচ বছরেই ব্র্যান্ড হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠে আজ শুধুই ‘ম্যায়’ এবং ‘মোদি’। বাদবাকি সবই প্রায় উধাও।

এই যেমন উধাও হয়ে গেছেন জনসংঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)র স্রষ্টারা, সংঘ পরিবারের গুরুরা কিংবা বিজেপি নামটাও। উত্তর প্রদেশ চষে ফেলেও বড় বড় হোর্ডিংয়ে মোদি ছাড়া দ্বিতীয় কারও ছবি নজরে আসেনি। গুজরাটের গান্ধীনগরের দলীয় প্রার্থী সভাপতি অমিত শাহ। তা ছাড়া তিনি ভূমিপুত্র। তাই তাঁর কিছু ছবি নজরে এসেছে। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও অটল বিহারি বাজপেয়ি কিংবা লালকৃষ্ণ আদভানির ছবি চোখে পড়েনি। চোখে পড়েনি দীনদয়াল উপাধ্যায়কেও। ছবি তো দূরের কথা, এই যে এত গাদা গাদা নির্বাচনী জনসভায় মোদি ভাষণ দিলেন ও দিচ্ছেন, কোথাও ভুলেও একবারের জন্যও তাঁর মুখে অতীতের দিকপাল নেতাদের কথা শোনা গেল না। দলটাকে যাঁরা এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন, মোদি-মাহাত্ম্য তাঁদের ব্রাত্য করে ফেলেছে!

বিজেপিতে দলকে ছাপিয়ে এভাবে কোনো ব্যক্তি কোনো দিন বড় হয়ে ওঠেননি। বড় হওয়ার চেষ্টাও করেননি। বাজপেয়ি-আদভানিরাও কখনো এভাবে ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে ওঠেননি। সেই চেষ্টাও করেননি। ভারতীয় গণতন্ত্র ব্রিটেনের ‘ওয়েস্টমিনস্টার মডেল’ অনুসরণ করলেও এবারের ভোটকে নরেন্দ্র মোদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঢংয়ে পরিচালিত করলেন। সেই কারণে এই প্রথম ভারতের ভোট একজন ব্যক্তির পক্ষে ও বিপক্ষে গণভোটের রূপ নিয়েছে। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে সেটা হবে নরেন্দ্র মোদির একার কৃতিত্ব। না পারলে তাঁর একার ব্যর্থতা।

বাংলা ভাষায় যা ‘আমরা’, হিন্দিতে তা ‘হাম’। বাংলায় যা ‘আমি’, হিন্দিতে তা ‘ম্যায়’। গত পাঁচ বছরে ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদির রূপান্তর এক কথায় বলতে গেলে ওই ‘হাম’ থেকে নির্ভেজাল ‘ম্যায়’-এ। ‘ইন্ডিয়া টুডে’ সংবাদমাধ্যমের ‘ডেটা ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ (ডিআইইউ) পাঁচ বছর আগের মোদির সঙ্গে পাঁচ বছর পরের মোদির কথাবার্তা ও ভাষণ খতিয়ে দেখেছে। ব্যাখ্যাও করেছে। এ জন্য তারা ২০১৪ সালের ভোটের আগে পাটনা, বরানসি, দিল্লি, মিরাট ও চেন্নাইয়ের পাঁচটি ভাষণ এবং ২০১৯ এর ভোট প্রচারে ভাগলপুর, কেন্দ্রপাড়া, মোরাদাবাদ, পানাজি ও বুনিয়াদপুরের ভাষণ খতিয়ে দেখে রূপান্তরের বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। পর্যালোচনায় ধরা পড়েছে ‘ব্র্যান্ড মোদির’ উত্থানের চরিত্রও।

পাঁচ বছর আগের ওই পাঁচ জনসভায় মোদির ভাষণে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল তা ‘গরিব’। মোট ৫৫ বার তিনি ওই শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। এরপর ছিল ‘কংগ্রেস’ (৪৩)। মনে রাখতে হবে, ২১০৪-র ভোট ছিল কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপির ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেই লড়াই জিততে তিনি ‘কৃষক’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন ২৮ বার, ‘উন্নয়ন’ ২৫, বিদ্যুৎ ২১ বার, দারিদ্র্য ১৯ বার। গুজরাট মডেলের উল্লেখ তিনি করেছিলেন ২৮ বার, দূষণের কারণে গঙ্গার নাম নিয়েছিলেন ২৩ বার। তখনো তিনি বিজেপিকে ছাপিয়ে বড় হননি। তাই দলের নাম উচ্চারণ করেছিলেন ৩১ বার।

হরিয়ানায় বিজেপির সমাবেশে নেতা-কর্মী সমর্থকেরা। ভারত, ০৮ মে। ছবি: টুইটার
হরিয়ানায় বিজেপির সমাবেশে নেতা-কর্মী সমর্থকেরা। ভারত, ০৮ মে। ছবি: টুইটার

পাঁচ বছর পর এবার ভোটের প্রচারে ওই পাঁচ কেন্দ্রের জনসভায় মোদির ভাষণে সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যে শব্দ, তাকে নিয়েই এবার বিতর্ক সর্বাধিক। মোট ১০৬ বার তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘চৌকিদার’ শব্দটি। পাঁচ বছরে কৃষি সমস্যা ও কৃষক অসন্তোষ জ্বলন্ত হয়ে ওঠা সত্ত্বেও মোদির কণ্ঠে ‘কৃষক’ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে মাত্র ৬ বার। ‘গরিব’ শব্দটি ৫৫ থেকে কমে হয়েছে ৪১, ‘বিদ্যুৎ’ ২১ থেকে কমে হয়েছে ১২। পাঁচ বছর আগের ওই পাঁচ জনসভায় ‘সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদী’ শব্দ ছিল অনুচ্চারিত। পাঁচ বছর পরের পাঁচ জনসভায় পাকিস্তান ও সন্ত্রাস উচ্চারিত ৩০ বার। পাঁচ বছর আগে অটল বিহারি বাজপেয়ির নাম নিয়েছিলেন ৬ বার, পাঁচ বছর পর একবারও ওই নাম মুখে আনেননি। পাঁচ বছর আগে ‘বিজেপি’ ৩১ বার উচ্চারিত হয়েছিল, পাঁচ বছর পর তা কমে হয়েছে ২১। পাঁচ বছর আগে নিজের নাম একবারও যিনি মুখে আনেননি, পাঁচ বছর পর পাঁচ জনসভায় সেই ‘মোদি’ উচ্চারিত হয়েছে ৪২ বার।

পাঁচ দফার ভোট শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে আর মাত্র দুই দফার ১১৮টি কেন্দ্রের নির্বাচন। দীর্ঘ এই প্রচার পর্বে নির্বাচনী ইস্যুর রূপান্তরও চমকপ্রদ। প্রচার শুরু হয়েছিল উন্নয়ন ও বিকাশ নিয়ে। সরকারের পাঁচ বছরের সাফল্য নিয়ে। সাফল্যের সেই সাতকাহনে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হতে থাকে কংগ্রেসের ‘ধারাবাহিত ব্যর্থতা’। কংগ্রেস রাফায়েলকে হাতিয়ার করায় অল্প দিনের মধ্যেই মোদির প্রচারের অভিমুখ বদলে হলো ‘চৌকিদার’। নিজেকে চৌকিদার বলে জাহির করার পাশাপাশি তাঁকে শুনতে হলো ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান। পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পর প্রচারে প্রাধান্য পেল ‘দেশের নিরাপত্তার’ প্রশ্ন। এখন এই শেষ বেলায় তাঁর প্রচারের অভিমুখ পুরোপুরি কংগ্রেসের দিকে। প্রয়াত রাজীব গান্ধীকে ‘এক নম্বরের ভ্রষ্টাচারী’ আখ্যা দিয়ে প্রচারকে তিনি করে তুলেছেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া ছিল গত পাঁচ বছরে তাঁর ব্রত, সেই কংগ্রেসই আজ তাঁর সবচেয়ে বড় নির্বাচনী শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে কেন এমন আক্রমণ? ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার স্লোগান তাঁর নিজের কাছেই আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিহাসের বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শাসনের লেখচিত্র নিম্নগামী হতে শুরু করেছিল মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যেদিন থেকে ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। বিজেপির চেয়েও বড় হয়ে ওঠা ‘ব্র্যান্ড মোদি’র লেখচিত্র ঊর্ধ্ব না নিম্নমুখী হবে, জানা যাবে ২৩ মে। তত দিন পর্যন্ত একটা টান টান উত্তেজনা থাকুক।