আজ নাগরিক তালিকা প্রকাশ, আসামে বিশেষ সতর্কতা

ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের প্রকৃত নাগরিকদের নামের তালিকা (এনআরসি) আজ প্রকাশিত হতে চলেছে। সকাল ১০টায় অনলাইনে তালিকা প্রকাশ করা হবে। এ নিয়ে গোটা রাজ্যে একদিকে যেমন সাজ সাজ ব্যস্ততা, অন্যদিকে তেমনই ঘনীভূত আশঙ্কা ও অশান্তির মেঘ।

আশঙ্কা ১৪টি জেলা নিয়ে। রাজ্যের মোট ৩৩টি জেলার মধ্যে ১৪টিকে রাজ্য সরকার স্পর্শকাতর বলে ঘোষণা করেছে। মুসলমান–অধ্যুষিত এলাকায় নেওয়া হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। বিজেপি শাসিত এই রাজ্যের পুলিশ জানিয়েছে, এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর কোনো রকম প্রতিবাদ বরদাশত করা হবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত ২০ কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। মোট আড়াই হাজার এনআরসি সেবাকেন্দ্র আগলাতে শুরু করেছে নিরাপত্তারক্ষীরা। বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিসহ স্পর্শকাতর ১৪ জেলার ওপর বিশেষ নজর রেখেছে প্রশাসন। এনআরসি ঘিরে গোটা রাজ্যের পরিবেশ থমথমে।

চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগের দিন শুক্রবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল রাজ্যবাসীকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়ে বলেছেন, কেউ যেন আতঙ্কগ্রস্ত না হন। যাঁদের নাম তালিকায় থাকবে না, তাঁদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে (এফটি) আবেদন জানাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নাগরিকত্ব প্রমাণে সরকার তাঁদের প্রত্যেককে সব রকমের সহায়তা দেবে।

একই রকম আবেদন জানিয়েছে আসাম রাজ্য পুলিশও। বলেছে, এনআরসিতে নাম না ওঠার মানে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া নয়। যাঁদের নাম উঠবে না, তাঁরা এফটিতে আবেদনের জন্য ১২০ দিন সময় পাবেন। এই সময়সীমা আগে ছিল ৬০ দিন। সরকার প্রত্যেককে আইনি সহায়তা দেবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অতিরিক্ত আরও ১ হাজার এফটি রাজ্যে খোলা হবে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ট্রাইব্যুনালে ব্যর্থ হওয়ার অর্থও বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া নয়। ব্যর্থ নাগরিকেরা প্রথমে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে পারবেন, তারপর সুপ্রিম কোর্টের। আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হলে কাউকেই ডিটেনশন ক্যাম্পে (ডি–ক্যাম্প) পাঠানো হবে না।

১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তিতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির কথা বলা ছিল। ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। কিন্তু দীর্ঘ টালবাহানায় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এনআরসি তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়। 

গোটা রাজ্যে খোলা হয় ২ হাজার ৫০০টি এনআরসি সেবাকেন্দ্র। ৫২ হাজার সরকারি কর্মী নিযুক্ত হন নাগরিক তালিকা তৈরির কাজে। খরচ হয় ১ হাজার ২২০ কোটি রুপি। নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার জন্য মোট আবেদন জমা পড়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৪। চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় স্থান হয় ২ কোটি ৮৯ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৭ জনের। বাতিলের তালিকায় ঠাঁই হয় ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জনের। পরে বাদ দেওয়া হয় আরও ১ লাখ ২ হাজার ৪৬৫ জনকে।

নাগরিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়া ৪১ লাখ ১০ হাজার ১৭২ জন নারী–পুরুষের অধিকাংশই হিন্দু ও মুসলমান বাঙালি। চূড়ান্ত তালিকায় নাম রয়েছে কি না, তা জানতে এঁরা সবাই বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন। যাঁদের নাম উঠবে না, তাঁদের প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ আজ থেকে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগের দিন আসামের তিনবারের সাবেক কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছেন, এনআরসি মানুষের আস্থা অর্জন না করে সন্দেহ ও বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। অবৈধ অনুপ্রবেশের সমস্যা শুধু এনআরসি দিয়ে মেটানো যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটা এনআরসি চেয়েছিলাম, যেখানে প্রকৃত নাগরিকদের একজনও বাদ যাবেন না। অথচ বিদেশিরা চিহ্নিত হবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা না করে এই প্রক্রিয়া কর্তৃপক্ষের যোগ্যতা, ক্ষমতা ও দায়বদ্ধতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।’

রাজধানী গুয়াহাটিতে সংবাদ সম্মেলন করে মুসলিম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব আসাম দাবি করেছে, এনআরসি প্রক্রিয়া চলাকালে ৭০ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাঁদের মধ্যে হিন্দু–মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই রয়েছেন।